এম এ হোসাইন

ইউক্রেন তার বহুল-প্রচারিত বসন্ত আক্রমণের পর দেখা গেছে যে তার আশানুরূপ অগ্রগতি লাভ হয়নি বরং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মত তার পর্যাপ্ত লোকবল ও যুদ্ধ সরঞ্জাম নেই। তাছাড়া ন্যাটো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ও যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহ করার অবস্থানে নেই। আমেরিকার ভিতরেই নীতিনির্ধারকগন যুদ্ধ চালিয়ে যাবার ঘোর বিরোধী। সুতরাং এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে ইউক্রেন এই যুদ্ধে হেরে গেছে।

ন্যাটোর সম্প্রসারণ রাশিয়ার জন্য একটি ভূ-কৌশলগত হুমকি স্বরূপ। চীন, দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের ভূ-কৌশলগত শক্ত অবস্থানকে নিজেদের অধিকার হিসেবে দেখে। চীনের উন্নতি দেখিয়েছে যে এই দেশ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে। বর্তমানে, রাশিয়ার সাথে চীনের কৌশলগত ঘনিষ্ঠ সহাবস্থান এবং বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর অধীনে অন্যান্য দেশের সাথে তার মজবুত সম্পর্ক বর্তমান শতাব্দীতে যে কোন মানদণ্ডে সম্পূর্ণ ভিন্ন কৌশলগত পদ্ধতির প্রতিনিধিত্ব করে। যখন পশ্চিমা মিত্রশক্তিরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে বহু জাতিকে ধ্বংস করে চলছিল তখন চীন তার’ নরম শক্তি’ প্রয়োগের মাধ্যমে অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে, তার কাঠামোগত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশীদার হয়েছে। এটি কেবল মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় নয় আফ্রিকাতেও এর প্রভাব বাড়িয়েছে। চীনের এই উত্থান পশ্চিমা শক্তির কাছে শঙ্কা ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। তাছাড়া, আফ্রিকায় বিশেষ করে পশ্চিম ও পূর্ব আফ্রিকায় এক এক করে পশ্চিমা মিত্রদের আধিপত্য হারানো পশ্চিমা যুগের সমাপ্তিও বটে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের এই আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির কারণে একটি কৌশলগত ব্লকের আবির্ভাব ঘটেছে যা পূর্ব এবং পশ্চিমের মাঝে এক বিভাজন রেখা একে দিয়েছে।মি: পুতিন জি-২০ সম্মেলন কে সমালোচনা করে বলেন, জি-২০ সম্মেলন মূলত সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সমন্বয়ের জন্য সৃষ্ট কিন্তু বর্তমানে তার রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। তিনি এর ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। মধ্য প্রাচ্যে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়ন চলছে বেশকিছু সময় ধরে। তার উপর, চীনের মধ্যস্থতায় রিয়াদ-তেহরান এর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন পশ্চিমাদের কাছে এক বজ্রাঘাত। মোহাম্মদ বিন সালমান যখন অতিরিক্ত তেল উত্তোলনের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অনুরোধ উপেক্ষা করেন, তখনই নিশ্চিত হয়েছিল মধ্য প্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য পতনমুখী।
সম্প্রতি জো বাইডেন চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর পাল্টা কৌশল হিসাবে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইসরাইলের মধ্য দিয়ে একটি ট্রান্স-আটলান্টিক রুট তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু, হামাস এবং ইসরাইলের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধের দামামা এই পরিকল্পনার কবর দিয়েছে।
দক্ষিণ এবং পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অন্তত এশিয়ায় চীন থেকে এক ধাপ পিছিয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিক অংশীদার রাষ্ট্রসমূহ যেমন: ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়া চীনের প্রভাব বলয়ের কাছে কৌশলগত চাপে রয়েছে। গত দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহের সরকারের সাথে অংশীদারিত্বের সম্পর্ক বজায় রেখে চলছিল কিন্তু চীন জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্কের নীতি বজায় রেখেছে যার ফল আজ তারা পাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া বরাবর বলে যাচ্ছে তারা শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় কিন্তু পশ্চিমারা তাদের একগুয়ে নীতির কারণে আজ একটি জাতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
নিঃসন্দেহে, হামাস-ইসরাইল যুদ্ধে ইরানের যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে। ইসরাইলের আগ্রাসী এবং উদ্ধ্যত পদক্ষেপ ফিলিস্তিনি জনগণের মাঝে চরম হতাশা এবং ক্ষোভ কাজ করছিল যা হামাসের উপর এক ধরনের কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করেছিল। তার পাশাপাশি ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যু, শিয়া আধিপত্যশীল মধ্যপ্রাচ্য গঠন এবং ইসরাইল-সুন্নী রাষ্ট্র সমূহ বিশেষ করে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিকরণ ভেস্তে দেবার উদ্দেশ্যে এই “অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড” শুরু করতে হয়। রাশিয়া এবং চীন অবশ্যই প্রস্তুত ছিল মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো আগ্রাসী পদক্ষেপের পাল্টা জবাব দিতে। যদিও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠনগুলো কর্তৃক জিম্মি আটকের ঘটনাটি এই যুদ্ধের এক ধরনের জটিল ডাইমেনশন দিয়েছে যা যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী করতে এবং অনুকূলে রাখতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামীদের সহায়ক হবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি উন্মাদমোখর নেতানিয়াহুর খপ্পরে পড়ে এই যুদ্ধে জড়ায় তাহলে এটাই হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি থেকে পতনের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকা।
(এম এ হোসাইন একজন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক)।