সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব খুবই উদ্বেগজনকভাবে আবির্ভূত হচ্ছে। বিশ্বের পন্ডিত, বিশেষজ্ঞ এবং নীতি নির্ধারকরা এই প্রভাবের ফলাফল ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা, আবহাওয়ার ধরন,এবং বাস্তুতন্ত্রের প্রতিকূল প্রভাব সহ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তাদের প্রভাব প্রশমিত করার জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রস্তাব করেছেন। বর্তমানে আমাদের এই পৃথিবী এক জটিল সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে যখন পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্র এবং মানব সভ্যতা এক চরম হুমকির সম্মুখীন। চরম বৈরী আবহাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, এবং কৃষি চর্চায় ব্যাঘাতের প্রভাবে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা, জীবিকা, বিশুদ্ধ পানির সহজলভ্যতা, এমনকি মানুষের অভিবাসন কে বিপন্ন করে তুলছে। কালের এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে, বৈশ্বিক সবুজায়নের উদ্যোগ গুলো পরিবেশগত ভারসাম্যকে উন্নীত করতে এবং মানব- প্ররোচিত পরিবেশ বিরোধী কার্যকলাপ যেমন: জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়ানো, বন উজার, এবং অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গ্রীন হাউজ গ্যাস, বিশেষ করে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মিথেন গ্যাসের নির্গমন গ্রীনহাউস প্রভাব তথা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির অন্যতম মূল কারণ। জীবাশ্ম জ্বালানি এই গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন এর প্রধান উৎস হলেও নগরায়ন এবং কৃষি কাজের জন্য বন উজার ও ভূমি ব্যবহার পরিবর্তনে গ্রীন হাউজ প্রভাবকে আরো বাড়িয়ে তুলে যা আমাদের বৈশ্বিক আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তন করে তুলেছে। অত্যন্ত উদ্বেগজনক বিষয় হলো, জুলাই ২০২৩ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস যা অতীতের উষ্ণতার সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে আমাদের এই পৃথিবীকে একটি তপ্ত যুগে প্রবেশ করিয়েছে।
বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের ক্রমাগত নির্গমনের কারণে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফলে তাপদাহ, হিমবাহ গলে যাওয়া, আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তন এবং বিশ্বব্যাপী কৃষি ও বাস্তুতন্ত্রের উপর মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনছে। উদাহরণস্বরূপ হ্যারিকেন, খরা, আকস্মিক বন্যা, এবং দাবানলের মত চরম জলবায়ু বিপর্যয়ের ঘটনাগুলোর তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অতি সাম্প্রতিক অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, এবং যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত বিধ্বংসী দাবানল কিংবা চীন, ভারত ও পাকিস্তানের আকস্মিক বন্যা পৃথিবীর সভ্যতা, অবকাঠামো এবং প্রাকৃতিক অভয়ারণ্যকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
হিমবাহ এবং মেরুর বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি করে চলেছে। যার ফলে উপকূলীয় ক্ষয়, মানব অভিবাসন, কৃষি ব্যাঘাত এবং সাধু পানির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই জলবায়ু পরিবর্তন গুলি বৈশ্বিক বাস্তুতন্ত্রের উপর মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে চলেছে। যার দরুন বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী, প্রাকৃতিক আবাসস্থল, এবং অভিবাসন ধরনের উপর বিরূপ প্রভাবের কারণে বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্রের বিলুপ্তি ঘটছে। অধিকন্তু এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। যেমন: হিট স্ট্রোক, অ্যাজমা, গর্ভাবস্থায় খিচুনি, অকালীন প্রসব, এবং হৃদরোগ ইত্যাদি। তাছাড়া তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমাজে মানুষের মাঝে আগ্রাসী স্বভাবের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা কিংবা মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে।
বৈশ্বিক সবুজায়নের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি সবুজ অর্থনীতি ও টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করা। কার্বন নির্গমনের মূল্য নির্ধারণ সে ক্ষেত্রে একটি দক্ষ, সাশ্রয়ী ও কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে গৃহস্থল থেকে বৃহৎ শিল্পাঞ্চল পর্যন্ত বিকল্প পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনায় উৎসাহিত করবে। এই কার্বন নির্গমনের মূল্য নির্ধারণে নতুন নতুন উদ্ভাবন কে আরো উৎসাহিত করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অর্থনীতিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়ে সে বিষয়ে মাথায় রেখে সবুজ অর্থনীতিতে আরো বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। সবুজায়নে সহায়ক প্রযুক্তি, পরিবহন, এবং সবুজ পুনরুদ্ধারে বনাঞ্চল পুনরুদ্ধার ও সম্প্রসারণের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। এতে করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ বৃদ্ধি পাবে ও জীব বৈচিত্র স্থিতিশীল হবে। তাই এই সবুজ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ের সংস্থাগুলির সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সবুজ উদ্যোগের সমাধান গুলোকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
২০১৫ সালে গৃহীত প্যারিস চুক্তি, যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্ব নেতাদের একত্রিত করার চেষ্টা করে, যার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো বৈশ্বিক উষ্ণতাকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ করা। এর জন্য অবশ্যই উন্নত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রনেতাদেরকে নীতি প্রণয়ন, প্রণোদনা প্রদান ও বিশ্বব্যাপী উদ্যোগের বিনিয়োগে একমত হতে হবে। জলবায়ু কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে অগ্রগতি হতে পারে। কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার উদ্যোগগুলো পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ও সহায়ক করে, স্বচ্ছ প্রতিবেদনের মাধ্যমে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। জলবায়ু পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সচেতনতা ও উৎসাহ বৃদ্ধিতে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এবং সবুজায়ন বাস্তবায়নে যে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা হল রাজনৈতিক অনিচ্ছা, আর্থিক বাধা, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প গোষ্ঠী থেকে প্রতিরোধ এবং সর্বোপরি কিছু উন্নত রাষ্ট্র থেকে সহযোগিতার অনীহা। এছাড়াও সম্প্রদায়ের অভিযোজন অক্ষমতা, নীতি নির্ধারণের বাধা, জনসচেতনতা, এবং শিক্ষাগত তফাত আরও জটিলতা যোগ করে। সুতরাং অর্থনৈতিক বৈষম্যকে প্রাধান্য দিয়ে, কার্যকরী অর্থ সহায়তা করে তার সঠিক পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, উন্নত রাষ্ট্রগুলো গ্রিনহাউস প্রভাবের জন্য সবচেয়ে বেশি দায় বহন করে আর উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলি তার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে আভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ ও বৈদেশিক সহায়তা তহবিল, উভয়েরই প্রয়োজন হবে।
নিঃসন্দেহে, বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট বিশ্বব্যাপী জলবায়ু জরুরি অবস্থা ঘোষণার দাবি করে। প্রাচীন চৈনিক একটি প্রবাদ হলো, “একটি বিম যতই শক্তিশালী হোক না কেন, একটি সম্পূর্ণ ঘরকে একা টেকাতে পারে না”। একইভাবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কে ঝুঁকিপূর্ণ বা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে যা তাদের জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে অভিযোজন সহায়তা বৃদ্ধি করবে। তা না হলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর চাপ উন্নত রাষ্ট্রের কাঁধেই ভর করবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ও স্থিতিশীল পৃথিবী সুরক্ষিত করার জন্য ব্যক্তি, সরকার এবং সংস্থাগুলোর সমষ্টিগতভাবে কাজ করা এবং সিদ্ধান্ত মূলক কৌশল গ্রহণ করা সমানভাবে অপরিহার্য। এটা আমাদের আজকের সকল চিন্তাশীল নাগরিকের নৈতিক বাধ্যতামূলক বিবেচনা হওয়া উচিত, যাতে আগামী প্রজন্মের কাছে একটি বসবাসযোগ্য পৃথিবী উপস্থাপন করতে না পারার অপরাধী হওয়া থেকে পরিত্রান মেলে।
(এম এ হোসাইন, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। ইমেইল : writetomahossain@gmail.com)