মোঃ সহিদুল ইসলাম:
ইসলামের মূল ভিত্তি পাঁচটি। পাঁচটি ভিত্তির একটি হলো রোজা। এটি মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো রোজা। ধর্মীয় রোজা বা উপবাস শুধুমাত্র একটি স্বতন্ত্র মুসলিম প্রথা নয়। এটি শতাব্দীর পর শতাব্দি ধরে বিভিন্ন জাতির ধর্মের মধ্যে অনুশীলন হয়ে আসছে। পবিত্র কোরআন মাজিদে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন: “হে ঈমানদারগণ তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমার পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরজ করা হয়েছিল” (বাকারা- ১৮৩)। যদিও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের রোজার ধরণ- প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন। মুসলিমরা রোজা পালন করলে বলা হয় “সিয়াম”। খ্রিষ্টানরা রোজা পালন করলে বলা হয় “ফাস্টিং”। হিন্দু, বৌদ্ধরা রোজা পালন করলে বলা হয় “উপবাস”। বিপ্লবীরা রোজা রাখলে বলা হয় “অনশন”। আর মেডিকেল সাইন্সে রোজা রাখাকে বলা হয় “অটোফেজি”।
অটোফেজি কি? অটোফেজি গ্রীক শব্দ। অটো অর্থ নিজে নিজে এবং ফেজি অর্থ খেয়ে ফেলা। সুতরাং অটোফেজি মানে নিজে নিজেকে খেয়ে ফেলা। মেডিকেল সাইন্সে নিজের মাংস নিজেকে খেতে বলে না। শরীরের কোষগুলো বাহির থেকে কোন খাবার না পেয়ে নিজেই যখন নিজের অসুস্থ কোষগুলো খেতে শুরু করে, তখন মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় তাকে বলে অটোফেজি। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অটোফেজি এবং রোজা এক জিনিস নয়। রোজা রাখলে অটোফেজির প্রয়োজন হয় না, অটোফেজি অটোমেটিক্যালি তৈরী হয়ে যায়।

পবিত্র মাহে রমজান। মোবারক মাস। রহমতের মাস। বরকতময় মাস। মাগফেরাতের মাস। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য এ মাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামে রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে। এছাড়া ওয়াজিব রোজা, সুন্নত রোজা, মুস্তাহাব রোজা, নফল রোজাও আছে। আবার বছরে পাঁচ দিন রোজা রাখা হারাম করা হয়েছে। যেমন- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দুই দিন এবং জিলহজ্ব মাসের ১১,১২ ও ১৩ তারিখ তিন দিন মোট এই পাঁচ দিন।
পবিত্র রমজান মাসের রোজা ছাড়া আরো অনেক রোজা রয়েছে। যেমন- শাওয়াল মাসের ছয় রোজা, আরাফার দিন রোজা, মহররমের রোজা, আশুরার রোজা, শবে মেরাজ, শবে বরাত এর রোজা, চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ ৩ দিন আইয়্যামে বিজের রোজা, সপ্তাহে দুইদিন সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- সোমবার ও বৃহস্পতিবার আল্লাহর নিকট বান্দার আমলনামা পেশ করা হয়। আমি পছন্দ করি যে, রোজা রাখা অবস্থায় যেন আমার আমলনামা আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়”। (তিরমিজি- ৭৪৭)
রমজান মাসের রোজা রাখার ফজিলত বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। রোজা রাখার বিজ্ঞানসম্মত শারীরিক, মানসিক উপকারিতা যেমন: দেহের সেল পরিস্কার করে, ক্যান্সার এর সেল ধ্বংস করে, ওজন কমাতে সাহায্য করে, ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে, পাকস্থলীর প্রদাহ দূর করে, ব্রেইনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়, পেশীশক্তি সংরক্ষণ করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, শরীর নিজে নিজে সেরে উঠে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে, দীর্ঘ জীবন লাভ করা যায়, ইত্যাদি।
রোজা রাখার উপকারীতা কুরআন হাদিসের আলোকে:- “তোমরা রোজা রাখো যাতে তোমরা সুস্থ থাকতে পারো। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:); আবু হুরায়রা (রা:); তারাবানী। “সব কিছুর জন্যই যাকাত (শুদ্ধি প্রক্রিয়া) রয়েছে, শরীরের যাকাত হচ্ছে রোজা।” আবু হুরায়রা (রা:) ইবনে মাজহা। হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:)বলেছেন- আল্লাহ তা’লা বলেন:- “রোজা ছাড়া আদম সন্তানের প্রত্যেকটি কাজই তার নিজের জন্য। তবে শুধু রোজা আমার জন্য। আমি নিজে এর পুরস্কার দেবো। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আত্মশুদ্ধির নিয়তে যে রমজান মাসে রোজা রাখে তার অতীত জীবনের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যাবে”। আবু হুরায়রা (রা:); বুখারী মুসলিম। “মানুষের প্রত্যেকটি সৎকর্মের নেকী আল্লাহ পাক গুণিতক করেন। ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি দান করেন। আর রোজার নেকি আল্লাহ নিজে দেবেন, কোন সীমা ছাড়া তাঁর ইচ্ছানুসারে”। আবু হুরায়রা (রা:); মুসলিম। রমজানে সারা মাস রোজা রাখার পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখার সুন্নত। হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা:) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন:- “যে ব্যক্তি রমজান মাসের সব ফরজ রোজাগুলি রাখলো তারপর শাওয়াল মাসে আরো ছয়টি রোজা রাখলো, সে যেন সারা বছর ধরেই রোজা রাখল”। (সহীহ মুসলিম- ১১৬৪)
রোজা মানুষের আত্মিক ও দৈহিক সুস্থতা অর্জনের সহায়তা করে। রোজা মানুষকে পার্থিব লোভ-লালসা, হিসাব-বিদ্বেষ, পরচর্চা, পরনিন্দা, মিথ্যাচার, প্রতারণা, অধিক ধন-সম্পদ অর্জনের আকাঙ্ক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং আত্মসংযমের শিক্ষা দেয়। রোজা সুন্দর সমাজ গঠনে যেমন পারস্পরিক স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া- মমতা, আন্তরিকতা, দানশীলতা, বদান্যতা, উদারতা,পরোপকারিতা, ক্ষমা, যাকাত- ফিতরা, সহানুভূতি, সমবেদনা প্রভৃতি সদাচরণের শিক্ষা দেয়। রোজার মাধ্যমে সমাজ জীবনে বয়ে আনুক আল্লাহভীতি, আত্মসংযম ও মানবপ্রেম। রোজার শিক্ষা যেন আমরা সারা জীবন সৎভাবে অতিবাহিত করে আল্লাহপাকের অশেষ করুণা ও ক্ষমা এবং জান্নাতুল ফেরদৌস লাভ করতে পারি,আল্লাহ সুবহানা তায়ালা সে তৌফিক দান করেন। আল্লাহপাক আমাদের সকলের জন্য রোজার রহমত, বরকত এবং মাগফেরাত অবধারিত করে দিন। তিনি আমাদের প্রত্যেককে সঠিক নিয়ম মেনে রোজা পালনের মাধ্যমে তার পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি অর্জনের তৌফিক দান করুন। আমিন।
(লেখক একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা)।