বিশ্বব্যাংক মনে করছে, চলতি অর্থ বছরে বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হবে না। তাদের বিবেচনায় বাংলাদেশের পক্ষে ৫.২ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে। কিন্তু বাংলাদেশের লক্ষমাত্রা ৭.৫ ভাগ।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় পাঁচটি ঝুঁকির কথাও বলেছে। আর ওই পাঁচটি ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপের মুখে রয়েছে। ঝুঁকিগুলো হলো- বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির চাপ, জ্বালানি ঘাটতি, লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি ও রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি। বিশ্বব্যাংক মনে করে, করোনা মহামারির সংকট মোকাবেলা করে বাংলাদেশ দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কারণে আবারও চাপের মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন,”বিশ্বব্যাংক যে ঝুঁকিগুলোর কথা বলছে তা যে সহসাই কেটে যাবে তেমন লক্ষণ নেই। তাই শেষ পর্যন্ত ৫.২ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জনও চ্যালেঞ্জিং হবে। এটাও যদি অর্জন করা যায় তাকেও অনেক ভালো বলতে হবে।”
তাদের কথা, “এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা দৃশ্যমান হচ্ছে না। তাই ভবিষ্যতের আশা বৈশ্বিক অবস্থার উন্নতি এবং প্রকৃতির উপরই অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।”
চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক তার পূর্বাভাস বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করলো। ২০২২ সালের অক্টোবরে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। জুনে পূর্বাভাস দিয়েছিল ৬.৭ শতাশ প্রবৃদ্ধির। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাংক “গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস” প্রতিবেদনে অবশ্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫.২ আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলে। তবে বিশ্বব্যাংক মনে করে, পরের অর্থ বছরে (২০২৩-২৪) বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৬. ২ হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। তাদের কথা এর অনেকগুলো নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির ওপর পড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে মার্চে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৩৩ শতাংশে, যা গত সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮.৭৮ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ৮.৫৭। এর আগে, গত বছরের আগস্টে দেশের মূল্যস্ফীতি হার ছিলো ৯.৫২ শতাংশ। তারপরও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম মনে করেন, দেশে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি “অস্বস্তিকর” অবস্থায় পৌঁছানোর মতো বেশি নয়।
বিশ্বব্যাংক বলছে, উচ্চ দ্রব্যমূল্যের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে লেনদেনের ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২০ কোটি ডলার, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৫৩০ কোটি ডলার। অর্থাৎ বিদেশি মুদ্রার মজুতে চাপ বাড়ছে। ডলারের একাধিক বিনিময় হারের কারণে ব্যালান্স অব পেমেন্টে চাপ বাড়ছে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। তাদের কথা, এতে রপ্তানি নিরুৎসাহিত হচ্ছে এবং প্রবাসী আয় কমছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, কাঠামোগত সংস্কার, যেমন বাণিজ্য সংস্কার ও রপ্তানি বহুমুখীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে। প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখার ক্ষেত্রেও তা সহায়ক।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন,” বিশ্বব্যাংক যে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে ৫.২ ভাগ, সেটাও যদি বাংলাদেশ অর্জন করতে পারে আমি মনে করি সেটাও একটা বড় অর্জন হবে।”
তার কথা,”বাংলাদেশের সামনে অর্থনীতির যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে তা সহসা চলে যাওয়ার নয়। তাই বাংলাদেশের জন্য এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ যে কোভিডের আগে যে প্রবৃদ্ধির ধারা ছিলো সেই জায়গায় কীভাবে ফিরে আসা যায়। একদিকে যেমন সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর চাপ। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও আছে। আমাদের সামাজিক দিকও দেখতে হবে। বিশেষ করে শ্রমবাজার, দারিদ্র্য, খাদ্য নিরাপত্তা। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় সামগ্রিকভাবে উদ্যোগ নেয়া দরকার। আগামী বাজেটে তার প্রতিফলন থাকতে হবে।”
আগামী অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধি বাড়ার যে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক সেই প্রসঙ্গে অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন,”বিশ্বব্যাংক হয়তো মনে করছে আগামী বছর বিশ্ব পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তাহলে রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স বাড়বে। তবে মনে রাখতে হবে বিশ্বব্যাংক কিন্তু পরিস্থিতি দেখে তাদের প্রজেকশন পরিবর্তন করে। চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির আগে যে পূর্বাভাস তারা দিয়েছিলো তা এই নিয়ে তিনবার পরিবর্তন করলো।”
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন,” বিশ্বব্যাংক অর্থনীতির যে চ্যালঞ্জেগুলোর কথা বলছে সেগুলো তো আছে। এরপরও আমাদের বড় সমস্যা হলো দুর্নীতি। সেই অর্থ আবার পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই দুইটি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এখনকার চেয়ে অর্থনীতি ভালো অবস্থায় থাকতো।”
তার কথা, “এটা আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছি। ব্যাংকগুলোর খারাপ অবস্থা, রাজস্ব আহরণ হচ্ছে না। তাহলে কি অর্থনীতির চাকা ঘুরছে না? আমরা একটি সমন্বিত পরিকল্পনার কথা বলেছিলাম। ব্যাংক রেট মুক্ত করার কথা বলেছিলাম। তেমন কিছু হয়নি। এখন আমরা নির্ভর করে আছি বিশ্ব পরিস্থিতি যদি ভালোর দিকে যায় এবং প্রকৃতি- মানে আল্লাহর ওপর। যদি কৃষি ভালো হয় তাহলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যাবে। তবুও যদি ৫.২ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায় তাহলে সেটা হবে অনেক ভালো খবর। তবে আমার মনে হয় এই প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে বেশ চ্যালেঞ্জিং।”
-ডয়চে ভেলে