মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ১০, ২০২৪

ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কারে ব্রতী হতে হবে: সুজন

পাঠক প্রিয়

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিসমাপ্তি এখনও ঘটেনি। গত ২১ জুলাই ২০২৪-এ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ের মধ্য দিয়ে কোটা সংস্কারের দাবির বিষয়টির এক ধরনের নি®পত্তি টানা হলেও ব্যাপক সহিংসতা, প্রাণহানি ও বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত স¤পদ ধ্বংসের মতো ঘটনা ঘটায় ১ জুলাই ২০২৪ থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন আর কোটা সংস্কারের দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নতুন এই অনুষঙ্গগুলো যুক্ত হওয়ায় যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তাতে কোটা সংস্কারের দাবির সাথে আরও কিছু দাবি যুক্ত হয়েছে। অপরদিকে সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত ও দমননীতির কারণে রাষ্ট্রে এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিক্ষিপ্ত-বিছিন্নভাবে কিছু কিছু দাবির ব্যাপারে ঘোষণা আসলেও এই অচলাবস্থা নিরসনে সমন্বিত কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।

প্রথমদিকে এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি সংবাদ সম্মেলনের পর সারাদেশে এর ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ও পুলিশি এ্যাকশনের কারণে এই আন্দোলন হয়ে ওঠে সহিংস। এক পর্যায়ে এই আন্দোলনের মধ্যে জামায়াত-বিএনপি’র অনুপ্রবেশের অভিযোগ ওঠে। বিপুল স¤পদের ধ্বংসযজ্ঞ ও সহিংতার ব্যাপকতা প্রত্যক্ষ করে দেশবাসী। এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক ব্যক্তির প্রাণহানির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে; যদিও সরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ১৫০। ৩১ জুলাই ২০২৪-এ প্রকাশিত সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সমকালের তথ্যে নিহতের সংখ্যা ২০৮ জন, সরকারি হিসাবে ১৫০ জন এবং শিক্ষার্থীরা বলেছেন ২৬৬ জন। প্রথম আলো’র হিসাবে এই তথ্য ২১১ জন। ২৯ জুলাই ২০২৪ প্রথম আলোতে প্রকাশিত নিহত ১৫০ জনের পেশাভিত্তিক বিভাজনে দেখা যায়, শিক্ষার্থী ৪৫ জন; দোকান, হোটেল, বিক্রয়কেন্দ্র ইত্যাদির কর্মী ২৫ জন; ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হকার ১৬ জন; দিনমজুর ও সমজাতীয় ১১ জন; গাড়ি, ট্রাক, রিকসা-ভ্যানচালক ও সহকারী ১৩ জন; পুলিশ ও আনসার ৪ জন; সাংবাদিক ৪ জন; চাকরিজীবী ৮ জন; পোশাকশ্রমিক ও কর্মী ৫ জন এবং অন্যান্য ১৯ জন। বয়সভিত্তিক বিভাজনে দেখা যায়, ৪-১৭ বছর বয়সী ১৯ জন; ১৮-২৯ বছর বয়সী ৯৪ জন; ৩০-৩৯ বছর বয়সী ২১ জন এবং ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সী ১৬ জন। এই আন্দোলনে আহত হয়েছে প্রায় সাত হাজার। স¤পদ ধ্বংসের ক্ষেত্রে দেখা যায় বাংলাদেশ টেলিভিশন, সেতু ভবন ও দুটি মেট্রোরেল স্টেশনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়া ও লুটপাট করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শত শত যানবাহন। নরসিংদী জেলা কারাগারের গেট ভেঙ্গে অস্ত্রাগার লুট করা হয়েছে এবং এ ঘটনায় ৯ জঙ্গীসহ ৮২৬ জন কয়েদি পালিয়ে যায়; যদিও পরবর্তীতে পালিয়ে যাওয়া বন্দীদের মধ্যে প্রায় পাঁচশত আত্মসমর্পণ করেছে এবং ৪ জঙ্গী প্রেপ্তার হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। পাশাপাশি লুট হওয়া ৮৫টি অস্ত্রের মধ্যে ৪৫টি উদ্ধার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সারাদেশে ৭৯৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১০,৩৭২ জন (জাগো নিউজ, ৩১ জুলাই ২০২৪); যার মধ্যে শিক্ষার্থী রয়েছে আড়াই শতাধিক। ৩১ জুলাই ২০২৪ প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, ডিএমপি’র তথ্য অনুযায়ী ২৯ জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত ২৪৩টি মামলায় ঢাকায় গ্রেপ্তার ২,৬৩০ জনের মধ্যে ২,২৮৪ জনের (৮৬.৮৪%) কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিএনপি’র নেতা-কর্মী ২৬৯ জন, জামায়াত ৬৩ জন, শিবিরের ১০ জন, গণ অধিকার পরিষদের ৩ জন এবং জেপি’র ১ জন। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলো। সারাদেশে নজিরবিহীনভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত বন্ধ দেওয়া হয়েছে। রেল যোগাযোগ, মেট্রোরেল যোগাযোগ বন্ধ। সড়ক যোগাযোগ আংশিক সচল। সারাদেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে কারফিউ দিয়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বয়কারীকে ডিবি হেফাজতে রাখা হয়েছে। সেখান থেকেই তাঁরা আন্দোলন প্রত্যাহারের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা ভয় দেখিয়ে করানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অপরদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আর একটি অংশ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

আন্দোলনের প্রেক্ষাপট: এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করতে গিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের ভাষ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কোটাপদ্ধতি প্রবর্তন করা হয় – তখনও সংবিধান প্রণীত হয়নি। সংবিধান প্রণীত হলে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে নাগরিকদের অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়নের কথা বলা হয়। ১৯১৮ সালে সেই সময় বিদ্যমান ৫৬ শতাংশের কোটা সংস্কারের দাবিতে ব্যাপক ছাত্র-আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের তীব্রতার কারণে ৪ অক্টোবর ২০১৮ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক পরিপত্র জারি করে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটা পদ্ধতি বাতিল করে। এই পরিপত্রের ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম লীগ কমান্ড কাউন্সিল। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রায় দেন ৫ জুন ২০২৪-এ। রায়ে ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার আদেশ দেয়া হয়। ১ জুলাই ২০২৪ থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শুরু হয় পরিপত্র পুনর্বহালের আবেদন; যা পরবর্তীতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে রূপ নেয়। ২১ জুলাই ২০২৪-এ পুর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির পর হাইকোর্টের রায় বাতিল করে সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে এবং ৭ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের আদেশ দেয়া হয়। ৭ শতাংশ কোটার বিভাজন হলো, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ ১ শতাংশ। রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেন, “এই নির্দেশনা ও আদেশ সত্তে¡ও সরকার প্রয়োজনে ও সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।” কোটা নির্ধারণ রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী বিষয় বলেও আদালত উলে­খ করেন। তবে সরকার এব্যাপারে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে কোটা বিষয়ে আদালত কর্তৃক ঘোষিত রায় অনুযায়ীই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই যে, ২০১৮ সলে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার না করে তা বাতিল করা ছিল সংবিধানিক আকাক্সক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। বর্তমানে যে কোটা ব্যবস্থা চালু হলো তাতে এখন পর্যন্ত সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসাবে বিবেচিত নারীরাসহ কোনো কোনো অঞ্চল পশ্চাৎপদই থাকবে কিনা তা সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। কেননা সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুয়ায়ী কোটা পুনর্বন্টনের ক্ষমতা সরকারের রয়েছে।

আজকের এই পরিস্থিতির কারণসমূহ: কোটা সংস্কার আন্দোলন আজকের এই অবস্থায় এসেছে বিভিন্ন কারণে। প্রথমত চীন সফর নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পর কোটা আন্দোলনকারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৪ জুলাই আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি ২০১৮ সালের আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সে সময় বিরক্ত হয়ে কোটা বাতিল করে দিয়েছিলেন, কোটা বাতিল করলে কি হয় তা দেখার জন্য। আদালতের রায় স¤পর্কে তিনি বলেছিলেন, “আদালত যখন কথা বলেছে, রায় হয়ে গেছে, সেই রায়ের বিরুদ্ধে আমার তো দাঁড়ানোর অধিকার নেই।” তিনি আরও বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবেনা? তাহলে কী রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?” এই সংবাদ সম্মেলনের পর ক্যা¤পাসে ক্যা¤পাসে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা ¯ে¬াগান দেয় ” তুমি কে, আমি কে; রাজাকার, রাজাকার”; কে বলেছে, কে বলেছে; স্বৈরাচার, স্বৈরাচার”; “চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার” ইত্যাদি। এই ¯ে¬াগান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। শিক্ষার্থীরা বলেছেন এই ¯ে¬াগান তাঁরা রূপক অর্থে দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, এটা ক্ষোভের ¯ে¬াগান। তাঁদের যুক্তি রাজাকারের অনুসারীরা কখনও বলবে না ‘আমি রাজাকার’। কেউ কেউ আন্দোলনকারীদের চিন্তাধারা ও মনস্তত্ত¡ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘কীভাবে এই ঘৃণিত ¯ে¬াগান তাঁরা উচ্চারণ করতে পারলো।’ আবার কেউ বলছেন আন্দোলনে শামিল হওয়া শিবির কর্মীরা এই ¯ে¬াগানটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। অনেকে বলেছেন, একটি এককেন্দ্রিক-নেতৃত্ববিহীন আন্দোলনে এমনটা ঘটা অসম্ভব কিছু না। তবে অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে যারাই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাঁদেরকে জামায়াত-বিএনপি হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই অস্ত্রটির এতো বেশি অপব্যবহার হয়েছে যে, এটি এখন ভোঁতা হয়ে গিয়েছে, ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ কয়েকজন মন্ত্রীর দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য এই আন্দোলনকে সহিংস করেছে। ১৫ জুলাই ২০২৪-এ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন “রাজাকার ¯ে¬াগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে। আন্দোলন থেকে আত্মস্বীকৃত রাজাকার ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতা বা আচরণের প্রকাশ ঘটেছে। এর জবাব দেওয়ার জন্যই ছাত্রলীগ প্রস্তুত।” তাঁর এই সংবাদ সম্মেলনের পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। তৃতীয়ত আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সহিংস আন্দোলনে পরিণত করেছে। ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের বিক্ষোভ মিছিল শুরুর আগে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন তাঁর বক্তব্যে বলেন, “যারা আমি রাজাকার বলেন, তাঁদের শেষ দেখে ছাড়বে ছাত্রলীগ।” তিনি আরও বলেন “ছাত্রলীগ রাজনৈতিকভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলন মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” তাছাড়া ছাত্রলীগের ক্ষমতা ও দৌরাত্ম এমনই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর সিট বন্টন হয় তাঁদের নির্দেশে। অনেক সমালোচনার পরেও কমনরুম কালচার, র‌্যাগিং কালচার ধরে রেখেছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে তারা প্রভ‚র মতো আচরণ করেন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেন তাঁদের দাস। মোট কথা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যা¤পাসে ও হলে পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। এ সকল কারণে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ ছিলো। চতুর্থত এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের পুঞ্জিভ‚ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। পদে পদে অপমান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন, বেকারত্ব, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট, গণতন্ত্রহীনতা, বিচারহীনতা, ভোটাধিকার বঞ্চিত হওয়া ইত্যাদি তরুণদের বিক্ষুব্ধ হওয়ার মূল কারণ। মোট কথা রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি, রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক সবকিছুর ওপর থেকেই তরুণদের আস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখানে কোটা সংস্কার ছিলো একটি উপলক্ষমাত্র; যাকে কেন্দ্র করে পুঞ্জিভ‚ত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। পঞ্চমত এই আন্দোলনকে যারা সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে নিয়ে যেতে চায়, তাঁরা এই আন্দোলনে শামিল হয়ে সুপরিকল্পিতভাবে সহিংসতা ছড়ানোসহ ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত হওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, তা অস্বাভাবিক বা অসম্ভব নয়। কিন্তু সমস্যা সমাধানে সরকারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে তাঁরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে থাকতে পারে। ষষ্ঠত গোয়েন্দা ব্যর্থতা ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহের নিরাপত্তা রক্ষায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না থাকাকে রাষ্ট্রীয় স¤পদ ধ্বংসের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। উর

প্রথম থেকে শুরু করে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হয়েছে ব্যাপকতার দিক থেকে এই আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালের বৃহত্তম অন্দোলনে পরিণত হয়েছিল; যার রেশ এখনও কাটেনি। সরকারের নীতি নির্ধারকদের বক্তব্য যদি সঠিক হয়, তবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি এবং সরকারের চাওয়ার মধ্যে তেমন কোনো ফারাক ছিলো না। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের প্রথমদিকের কথা-বার্তা ও আচার-আচরণে তাঁদেরকে শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ বলে মনে হয়েছে। সঙ্গত কারণেই সরকারের প্রকৃত অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশাও সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের শক্তিকে সরকার তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখেছে। তাঁদের দাবি মেনে নেয়ার ব্যাপারে আন্তরিকতার চেয়ে সরকারকে আন্দোলন দমানোর ব্যাপারে আগ্রহী এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী বলে মনে হয়েছে। মন্ত্রীসভার সদস্যগণ শপথ গ্রহণকালে অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কাজ না করার যে শপথ গ্রহণ করেন, তাঁদের আচরণে এই শপথকে সমুন্নত রাখার ব্যাপারে তাঁরা যে যথেষ্ট সজাগ, তা মনে হয়না। সুজন মনে করে, প্রথম অবস্থায় আন্দোলনকারীদের
সাথে বসার উদ্যোগ নিলে, আজকে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা হয়তোবা হতো না। আদালতের রায় ঘোষণার পরেও সরকার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে বসে তাঁদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিতে পারতো। উলে­খ্য, বিষয়টি নিয়ে আর্ন্তজাতিক মহলেও ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে এবং জাতিসংঘসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা বিবৃতি দিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যেই দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের উদ্যোগে বিচারপতি এম এ মতিন এবং মানবাধিকার সংগঠক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের নেতৃত্বে আন্দোলনে নিহত, গুলিবর্ষণ, গ্রেপ্তারসহ নির্যাতনের নানা ঘটনার সত্য উৎঘাটনে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি গণতদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছে।

অচলাবস্থা নিরসনে করণীয়সমূহ: যেহেতু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সূচিত চলমান আন্দোলন কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, তাই এই অচলাবস্থা নিরসনে সর্বোচ্চ আদালতের রায় এবং বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্নভাবে দাবিপূরণের আশ্বাস এখন যথেষ্ট নয়; এখন প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। এ জন্য সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ আন্দোলকারী শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সাথে বসতে হবে এবং অচলাবস্থা নিরসনে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহল থেকে উঠে আসা সংশ্লিষ্ট সকলের যৌক্তিক দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দিতে হবে।

সুজন-এর বিবেচনায় যে বিষয়গুলোর উপর সরকারের গুরুত্বারোপ জরুরি তা নিæরূপ:

১। নিহতদের নাম পরিচয়সহ বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত তালিকা প্রকাশ করা।

২। নিরপেক্ষ ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সহিংসতার সব ঘটনার স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করা এবং দায়ীদের বিচারের ব্যবস্থা করা। একইসাথে জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানে একটি আন্তর্জাতিক তদন্তও হওয়া উচিত বলে আমরা করি।

৩। ডিবি হেফাজতে আটকে রাখা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের অবিলম্বে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া; আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মামলা প্রত্যাহার, নতুন করে মামলা না দেওয়া এবং গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দেওয়া (কেননা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীরাই বলছেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সহিংসতায় লিপ্ত হয়নি) এবং গায়েবি মামলা ও ব্লক রেইড দিয়ে ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার বন্ধ করা। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের নিরাপত্তা দেওয়া এবং ভবিষ্যতে হয়রানি না করার অঙ্গীকার করা।

৪। সহিংসতায় নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা এবং প্রয়োজনের নিরীখে পরিবারের কোনো সদস্যের চাকুরির ব্যবস্থা করা; আহতদের সরকারি খরচে চিকিৎসাসেবা প্রদানসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।

৫। শিক্ষার ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গন-সহ জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে কাউফিউ তুলে নিয়ে এবং ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করে বাক্স্বাধীনতা-সহ জনগণের সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।

৬। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সিট বাণিজ্য বন্ধ করে যথাযথ নিয়মে প্রশাসনিকভাবে সিট বরাদ্দ করা, অছাত্রদের হলে অবস্থান নিষিদ্ধ করা এবং কমনরুম কালচার, র‌্যাগিং কালচার ইত্যাদি বন্ধ করা। ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের ছাত্রত্ব বাতিলের অঙ্গীকার করা। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশে সারাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা।

৭। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধান অনুযায়ী লেজুরবৃত্তির ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং স্বাধীন ছাত্ররাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা।

৮। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার বন্ধ করা এবং পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো থেকে বিরত থাকা।

৯। গণতান্ত্রিক অধিকারসহ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।

১০। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা এবং সংবিধানকে প্রকৃত অর্থেই অসা¤প্রদায়িক চরিত্রে ফিরিয়ে আনা।

আমরা মনে করি ছাত্রসমাজসহ নাগরিকদের যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণের মধ্য দিয়েই চলমান আন্দোলন ও অচলাবস্থার নিরসন ঘটানো উচিত। আর সরকার যদি বল প্রয়োগের মাধ্যমে এই আন্দোলনকে দমন করতে চায় এবং এ ব্যাপারে সক্ষম হয়, তবে ভবিষ্যতে আবারও বড় ধরনের অসন্তোষ মোকাবেলার জন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে; যার পরিণতি হতে পারে আরও ভয়াবহ। ইতোমধ্যেই শিক্ষার্থীরা আরারও রাজপথে নামা শুরু করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গতকাল পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করেছে। সংগঠনটির আজকের কর্মসূচি ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ (আমাদের নায়কদের স্মরণ)।

পরিশেষে আমরা বলতে চাই যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মিকে গড়ে তুলতে হলে আমাদেরকে সুদূর প্রসারী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কারে ব্রতী হতে হবে। আর সেই রাজনৈতিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে দেশে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পরিবর্তে আদর্শভিত্তিক জনকল্যাণমুখী রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সে জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে ঐকমত্য। আশাকরি সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে সেই শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মিকে আমাদের স্বপ্নের মতো করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।

সর্বশেষ সংবাদ

এসটিএস গ্রুপের জন্য কো-ব্র্যান্ডেড লংকাবাংলা ক্রেডিট কার্ড

লংকাবাংলা ফাইন্যান্সপি এলসি, এসটিএস ক্যাপিটাল লিমিটেড (এসটিএসগ্রুপ) ও মাস্টারকার্ডের সহযোগিতায় সম্প্রতি একটি কো-ব্র্যান্ডেড টাইটেনিয়াম ক্রেডিট কার্ড চালু করা হয়েছে।...

বৈষম্য নিরসনে অর্থব্যবস্থার ৮ দফা সংস্কার প্রস্তাবনা

অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে সংস্কার কমিশন গঠন, সংবিধানে সামাজিক মালিকানার স্বীকৃতি ও অর্থব্যবস্থার ৮ দফা সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ও আলোচনা সভা করেছে ফোরাম...

শেখ হাসিনা পালায় না !!!

জনরোষের মুখে শুধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার ঘটনা মানতে পারছেন না আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রীরা। তারা বলছেন, তিনি...

গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করল বাংলাদেশ

গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সাপ্তাহিক বৈঠকে অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপদেষ্টাদের করতালির মধ্যে এই সনদে...

বালা মুসিবত আমাদের হাতের কামাই: পীর ছাহেব ছারছীনা

পৃথিবীর সকল বালা মুসিবত আমাদের হাতের কামাই। মানুষ ধীরে ধীরে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ায় আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের প্রকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে সতর্ক করে...

জনপ্রিয় সংবাদ

সিভি এবং চাকুরী আবেদনের কিছু প্রয়োজনীয় টিপস

মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করার বদৌলতে প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখে পরতে হয়। যার অধিকাংশই আসে সিভিকে কেন্দ্র করে। আমি সিরিজ আকারে সিভি এবং ক্যারিয়ার...

মিথ্যা সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে তুরাগ থানা ছাত্রলীগ

তুরাগ থানা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মোঃ আরিফ হাসান জানায়, গত ১১-০৮-২০২০ তারিখে ’আমার প্রাণের বাংলাদেশ’ নামক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে ‘রাজধানীর উত্তরা যুবলীগ নেতা নাজমুল হাসান...

 ফিনান্সিয়াল অ্যাসোসিয়েট পদে নিয়োগ জোরদার করলো মেটলাইফ বাংলাদেশ

ফিনান্সিয়াল অ্যাসোসিয়েট হিসেবে যোগদানে আগ্রহী প্রার্থীদের জন্য ডিজিটাল নিয়োগ প্ল্যাটফর্ম উন্মোচন করেছে মেটলাইফ বাংলাদেশে। অনন্য এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আগ্রহী প্রার্থীদেরকে বাসা থেকেই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে...

২৩ কোটি বছরের পুরনো হিরকখণ্ড উদ্ধার!

দেখতে কি সুন্দর হিরকখণ্ডটি । শুক্রবার রাশিয়ার অ্যানাবার নদীর ধারে আলরোসার এবেলিয়াখ খনি থেকে উদ্ধার হয় এই হিরক খণ্ডটি। এখনও স্থির হয়নি হিরকখণ্ডটি পালিশ...
Verified by MonsterInsights