ফররুখ খসরু
—————————————————————-
৫৬০০০ বর্গমাইলের জন্মক্ষণটা ছিল ১৯৪৭। ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে এর সূচনা। তবে মাতৃগর্ভে এর অবস্থান টের পাওয়া গিয়েছিলো তারও আগে, ১৯০৫ সালেই। কিন্তু একটি মাহেন্দ্রক্ষণ সৃষ্টির আগেই এর অস্তিত্ব ধামাচাপা পড়ে যায় সামন্ত প্রভুদের বদনজরে।
ধরিত্রীর গোলার্ধ্ব দুটি। উত্তর আর দক্ষিণ। উত্তরের কাছে সম অধিকার আদায়ে দক্ষিণেরা সাউথ-সাউথ আন্দোলন করে যাচ্ছে। আমরা দক্ষিণ গোলার্ধ্বের বাসিন্দাদের কাছে উত্তর যেন এক অধরা হাতছানি। ভারত তো এই ধরিত্রিরই একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। উত্তরের রাজ্যগুলোই নিয়ন্ত্রণ করছে দিল্লির রাজনীতি ও রসদ। ১৯৩৫ এ মাতৃভাষার মর্যাদাকে কেন্দ্র করে ভূধামে প্রথম আন্দোলন গড়ে উঠে দক্ষিণ ভারতেই। উত্তরের ব্রা²ণ্য সমাজ তুড়ি মেরে তা উড়িয়ে দেয় বিভৎস হত্যা ও জিঘাংসার মাধ্যমে। ১৯৬৫ পর্যন্ত ভারতে ভাষার দাবিতে আন্দোলন চললেও ভাষাকে কেন্দ্র করে কোন জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেনি ভারত ভূখন্ডে। তবে অতীব সুখ এবং দুঃখের সহিত, ১৯৪৮ সাল হতেই ভারতবর্ষের এই ভাষা লিগ্যাসি বহন করে চলছে সদ্যোজাত পাকিস্তানের পূর্বাংশ ৫৬০০০ হাজার বর্গমাইল, যেখানে নিবাস আছে ফেলে দেয়া বিভক্ত বাঙালির অবহেলিত চাষাভুষো প্রজাগণের।
পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্ম ধর্মকে ভিত্তি করে। কিন্তু ধর্ম তো কোন জাতীয়তাবাদ বা রাষ্ট্রীয় চেতনার জন্ম দিতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্যে তাই আরব জাতীয়তাবাদের জন্ম হলেও মুসলিম জাতীয়তাবাদের উম্মেষ হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের জনগন বরং তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের পরিচয়েই নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন। তাই পাকিস্তানের জন্ম প্রক্রিয়াতেই এক ধরণের ত্রুটি বিদ্যমান ছিলো। মূলতঃ ভারতবর্ষের স্বার্থান্বেষী হিন্দু ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের ভুলের মাসুল দিয়ে চলছে ৫৬০০০ বর্গমাইলের ‘পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশ’এর জনগণ। কেউ কেউ হয়তো ইতিহাসের বিভিন্নকালে বিভিন্ন মুসলিম শাসকদের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে ধর্মকেন্দ্রিক এক ধরণের রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা বলে থাকেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এদের অধিকাংশই মহানবী (স:) নিজে পরিচালিত মদীনা সনদের আলোকে গঠিত রাস্ট্র ব্যবস্থার প্রতি একধরণের অনাগ্রহ প্রদর্শন করেন। মনে রাখতে হবে, ব্যাক্তিগত সততা রাস্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা নয়। বরং রাষ্ট্র পরিচালনায় মহানবী (স:) এর জীবদ্দশায় প্রদর্শিত আদর্শই উত্তম পন্থা।
১৯৪৭ সালে বাংলার বৃহৎ অংশটি অনেকটা অনিচ্ছাকৃতভাবেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হয়ে পড়ে। ১৯৪০ এর লাহোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হবার পর বাংলার নেতৃবৃন্দ অনেকটাই উত্তর ভারতীয় ব্রাক্ষ্ণ্যণ্য শ্রেনী এবং আশরাফ গোষ্ঠীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেন অথবা ঘটনার পারম্পিকতায় নিতে বাধ্য হন। কিন্তু ৪৭ এর দেশ ভাগের পর পাকিস্তানের এই পূর্বাংশ একই সাথে উত্তর ভারতীয় ব্রাক্ষ্ণ্যণ্য শ্রেনী এবং আশরাফ গোষ্ঠীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দের জন্য মাথা পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মুসলিম লীগ পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে ইসলামকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম দিতে চেয়েছিলো, এর পূর্ব অংশে ভাষাকে কেন্দ্র করে ঠিক তার বিপরীত ধারাতে উজ্জীবিত হতে থাকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। পুর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ বিবর্তিত হয়ে প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ, এবং তারও পরে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগে পরিণত হয়। ভারতবর্ষে ভাষাকে কেন্দ্র করে দক্ষিন ও পূর্ব ভারতে ব্যাপক আন্দোলন ব্যর্থ হলেও পূর্ব পাকিস্তানে বহিঃশক্তির প্রভাব ও অভ্যন্তরীণ ভাষা কেন্দ্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে এ দেশে ক্রমান্বয়ে লাহোর প্রস্তাবের যৌক্তিকতা বিস্তারিত হতে থাকে। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ক্রমান্বয়ে পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত হতে থাকে। এবং একই সাথে তা পাশ্ববর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলিতেও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাই পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও মিজোরাম থেকে অকৃত্রিম আশ্রয় ও মনোজাগতিক সহায়তা পাওয়া যায়।
৫০ দশকের ভাষা কেন্দ্রিক যে আন্দোলন জাতীয়তাবাদ তৈরির প্রাথমিক উদ্দীপণা হিসেবে কাজ করেছিলো, ৬০ এর দশকে এসে এর রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠে সমাজতন্ত্র। এ দশকেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সাহেবের রহস্যজনক মৃত্যুর কারণে বাঙ্গালীর রাজনৈতিক মানসপটে উদার জাতীয়তাবাদী চেতনা বিন্ষ্ট হতে শুরু করে। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘তোরা সব মানুষ বাঙ্গালী হয়ে যা’ এই উক্তির প্রতিক্রিয়ায় ৫৬০০০ বর্গমাইলে নৃতাত্তি¡ক বিভেদের রূঢ় চিত্র প্রকাশিত হতে শুরু করে। তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অগ্নি ধারা এ ক্ষেত্রে আগ্নেয়গিরির ধারা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর হিমালয়সম দেশপ্রেম দিয়েও এ ধারা রোধ করা যায়নি। চুড়ান্ত ক্ষেত্রে বাকশাল তৈরির মাধ্যমে এ আগুন চাপা দেয়ার চেস্টা করা হলেও বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। ফলতঃ শুধুমাত্র ৫৬০০০ বর্গমাইলই নয়, এর পাশ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতেও বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদের স্ফলিঙ্গ স্তিমিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এভাবে জাতীয়তাবাদের একটি অধ্যায় চাপা পড়ে যায়।
৫৬০০০ বর্গমাইলে আত্মপরিচয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা ঘটে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার একেবারে সূচনাকালে, বঙ্গবন্ধু যখন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে, আওয়ামী নেতৃত্ব যখন দিকভ্রান্ত, এসময় একজন মেজরের কন্ঠস্বরই নেতৃত্ব শুন্যতা থেকে বাংলার মানুষকে মুক্তির স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। পঁচাত্তরের কালো রাতের নৃশংসতায় জাতি যখন আবারো অভিভাবক শুণ্য, অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আবারো পটভূমিতে আসেন জেনারেল জিয়া। উর্দি পরা জিয়া রাজনীতিতে ততটা অভিজ্ঞ না হলেও ব্যক্তিগত সততা ও একই সাথে সামরিক নেতৃত্বের কৌশলে নিজের অবস্থান সুসংহত করতে সমর্থ হন। তবে ক্ষমতার মসনদে জেনারেল জিয়ার টিকে যাবার মূল দুটি কারণ হচ্ছে — বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বহুদলীয় গণতন্ত্র। এই দুই কারণেই প্রতিবেশী রাস্ট্র ভারত, মার্কিন পরাশক্তি এবং মুসলিম বিশ্বেও সকলের কাছে জেনারেল জিয়া সমভাবে সমাদৃত হতে থাকেন। এ সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে অকস্মাৎ জেগে উঠা ভূল বামপন্থাও নিজেদের অন্তর্কলহে ক্ষয় হতে শুরু করে। অপরদিকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বাকশালভুক্ত সকল রাজনৈতিক দল এবং একই সাথে জামায়াতে ইসলামীসহ পূর্বতন মুসলিম লীগ ঘরানার সব শক্তি রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠে। জামায়াতে ইসলামীসহ পূর্বতন মুসলিম লীগ ঘরানার এই রাজনৈতিক দলগুলো নতুন জাতীয়তাবাদকে ইসলাম ধর্ম দিয়ে প্রভাবিত করতে শুরু করে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বাহিরে গিয়ে জামায়াতে ইসলামী স্বৈরশাসক এরশাদের সময়কালে একটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষভূক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়। এভাবে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির সকল পক্ষই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ইসলাম ধর্ম প্রভাবিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে স্বীকার করে নেয়। ১৯৯১ সালে জেনারেল জিয়ার অবর্তমানে তাঁর সহধর্মিনী বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় আসার একটি বড় প্রভাবক ছিলো এই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ।
সংবিধানের মূল চার নীতিতে ফিরে যাওয়ার বাস্তবতায় এ দেশে এখন আর কোন রাজনৈতিক দলই নেই। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকলেও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে এখন আর দলটি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পুরোণো ঐতিহ্যে ফিরতে ইচ্ছুক নয়। বরং আওয়ামী লীগ আজ অত্যন্ত সচেতনভাবেই ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করা তথাকথিত ধর্মান্ধ শক্তিকে ব্যবহার করে আসছে।
গণতন্ত্রহীন আজকের বাংলাদেশে আত্মপরিচয়ের জিজ্ঞাসা খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র বাঙ্গালী পরিচয়ের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক পরিচয় অবলুপ্ত হয়ে পড়েছিলো সত্য, তবে শুধুমাত্র বাংলাদেশী পরিচয়ের মাধ্যমে আজ আমাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বিলুপ্তির পথে। সকল ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে আমরা কি আজ বাংলাদেশী বাঙ্গালী, বাংলাদেশী চাকমা, বাংলাদেশী মারমা, বাংলাদেশী সাঁওতাল এভাবে একইসাথে আমাদের রাজনৈতিক ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়কে তুলে ধরতে পারি না?
(ফররুখ খসরু একজন সাংবাদিক ও গবেষক)।
————————