গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা” অন্যতম উপাদানগুলোর একটি, যার মাধ্যমে চিন্তা ও মতামতের বৈচিত্র ফুটে উঠে। একজন গণতান্ত্রিক সরকারকে অবশ্যই বুঝতে হবে “সমালোচনা” গণতন্ত্রের ভিত্তি। দণ্ডবিধি,১৮৬০ এর ধারা ১২৪-ক’তে মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান ….
—- লিখেছেন অনিমা ইসলাম অহনা।
একটি শব্দ যেকোনো বাক্যের অর্থ এবং সারমর্মকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।
এবং সেটি যদি ঘটে যায় দণ্ডবিধির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি আইনে তবে নিঃসন্দেহে তা রাষ্ট্র এবং জনগণের জন্য হুমকিস্বরূপ।পাশাপাশি এটি বিতর্ক সৃষ্টিরও একটি সম্ভাবনা তৈরী করে।
এবার আসি কেন এটি বিতর্কের সৃষ্টি করে! যেকোনও আইনের কোনো একটি শব্দ যদি আইনটির উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তবে তা বিতর্কের সৃষ্টি করবেই।
মূল আলোচনায় আসা যাক। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা” অন্যতম উপাদানগুলোর একটি, যার মাধ্যমে চিন্তা ও মতামতের বৈচিত্র ফুটে উঠে। একজন গণতান্ত্রিক সরকারকে অবশ্যই বুঝতে হবে “সমালোচনা” গণতন্ত্রের ভিত্তি। দণ্ডবিধি,১৮৬০ এর ধারা ১২৪-ক’তে মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান। একটু যদি আমরা খেয়াল করি ধারাটি সেখানে লিখা আছে-
“যে ব্যাক্তি কথিত বা লিখিত শব্দাবলীর দ্বারা অথবা সংকেতসমূহের দ্বারা, বা দৃশ্যমান কল্পমূর্তির দ্বারা, অথবা প্রকারান্তরে আইনবলে প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি ঘৃণা বা অবজ্ঞার সৃষ্টি করে বা করার উদ্যোগ করে অথবা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা করার উদ্যোগ করে সেই ব্যাক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা এমন যেকোনো স্বল্প কারাদন্ডে দন্ডিত হবে যার সঙ্গে অর্থদণ্ড যোগ করা যাবে অথবা এমন তিন বছর মেয়াদী কারাদণ্ডে দন্ডিত হবে যার সঙ্গে অর্থদণ্ড যোগ করা যাবে, অথবা অর্থদণ্ডে দন্ডিত হবে।”
এই ধারাটি উদ্দেশ্য হলো জনগণকে রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখা। দূর্ভাগ্যবশত, এই ধারাটির অপব্যবহার করার একটি সুযোগ করে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র একটি শব্দের দ্বারা। ধারাটি মনযোগ সহকারে পড়লে আমরা দেখতে পাই, এই ধারাটি সরকারকে রক্ষা করে, রাষ্ট্রকে নয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি সংজ্ঞায়িত করার সময় রাষ্ট্রের পরিবর্তে সরকার শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যার ফলস্বরূপ যেকোনো ক্ষমতাসীন দল নিজ স্বার্থে বা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অপব্যবহার করতে পারে। এই ধারাটির ব্যাখ্যা-৩ একটু আলোকপাত করি-
“ঘৃণা, অবজ্ঞা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি বা সৃষ্টির উদ্যোগ না করে সরকারের প্রসাশনিক বা অন্যবিধ ব্যবস্থা অনুমোদনকারী সমালোচনাসমূহ এই ধারার অধীনে কোনো অপরাধ গঠন করে না।”
এখানে “ঘৃণা”, “অবজ্ঞা” বা “বিদ্বেষ” এই তিনটি বিষয়ের কোনো প্যারামিটার নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। এবং ঘৃণিত কোনো কর্মকাণ্ডের পরও যদি কেউ ঘৃণা প্রকাশ করতে না পারে সেটিও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করাই হয়ে দাঁড়ায়। কিছুদিন আগের ঘটনাই যদি উদাহরণস্বরূপ বলি,মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের ছিল না, এছাড়াও বেশকিছু মৌলিক অধিকারও লঙ্ঘিত হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এসকল ঘৃণিত কিছু কাজের ফলেই ঘৃণা, অবজ্ঞা প্রকাশ পায় একজন থেকে বহুজনের মাঝে। সৃষ্টি হয় নতুন একটি অভ্যুত্থানের। আর এভাবেই আমরা স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি।
2002 সালে, ফরমার কমিশন অন হিউম্যান রাইটস নিম্নলিখিত বিষয়গুলিকে গণতন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান হিসাবে ঘোষণা করেছিল: মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা, মেলামেশার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন অনুযায়ী ক্ষমতায় প্রবেশ এবং তার প্রয়োগ, জনগণের ইচ্ছার অভিব্যক্তি হিসেবে সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং গোপন ব্যালটের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমিক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের বহুত্ববাদী ব্যবস্থা, ক্ষমতার বিভাজন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জনপ্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং মুক্ত, স্বাধীন ও বহুত্ববাদী মিডিয়া। এমনকি মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রেও( ইউডিএইচআর) “মত প্রকাশের স্বাধীনতা” উল্লেখ আছে [আর্টিকেল ১৯]।
সরকার এবং রাষ্ট্র দুটি পৃথক সত্তা। এদেশের জনগণ সরকারের সমালোচনা করার অধিকার রাখে। আর এই অধিকার বাংলাদেশের সংবিধান প্রজাতন্ত্রকে দিয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে তা স্পষ্ট। “সরকার” ব্যবহার করার মাধ্যমে সংজ্ঞাটি বোঝায় যে সরকারের নীতি বা কর্মের যে কোনো সমালোচনাই রাষ্ট্রদ্রোহ। এটা গণতন্ত্রের নীতি ও অধিকারের পরিপন্থী। সাংবাদিকদের দমিয়ে রাখতেও রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি ভূমিকা রাখে। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি পর্যালোচনা ও সংশোধন করা প্রয়োজন যেন এর সুবিধা নিশ্চিত করা যায় এবং মৌলিক অধিকার রক্ষা করা যায়। সুতরাং, বিভ্রান্তি ও অপব্যবহার রোধ করতে “সরকার” শব্দটির পরিবর্তে “রাষ্ট্র” ব্যবহার করা উচিত।
[লেখক শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ]