স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট
নারী-পুরুষের সমতা, সম-সুযোগ, সম-মর্যাদাবোধ ও উন্নয়ন একটি দেশের তথা জাতির উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। কিন্তু সুদীর্ঘকাল ধরেই বিশেষ করে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক, অসম অধিকার ও বৈষম্যের কারণে নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে আছে। জাতিসংঘ বিশ^জুড়ে নারী এবং পুরুষের বিভেদ রদ করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। আগামীকাল ৩ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সিডও দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডও একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি/সনদ যাকে বলা হয় নারীর অধিকার রক্ষার আন্তর্জাতিক দলিল। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে সিডও সনদ স্বাক্ষর করেছে এবং এটি বাস্তবায়নে বার বার তাদের অঙ্গীকার পুর্নব্যক্ত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে সিডও সনদের ধারা ২ এবং ১৬.১.গ-এর উপর সংরক্ষণ আরোপ করে রেখেছে। বাংলাদেশের সুশীল সমাজের পাশাপাশি জাতিসংঘের সিডও কমিটির পুনঃ পুনঃ সমালোচনা এবং দাবি সত্তে¡ও, এবং বার বার প্রতিশ্রæতি দিয়েও বাংলাদেশ সরকার এই সংরক্ষণ প্রত্যাহারে এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এতে দেশে সনদের পূর্ণ বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, কেননা এই দুটি ধারাই হচ্ছে সিডও সনদের প্রাণ।
একথা সত্যি যে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে অন্যান্য আর্থ-সামাজিক বিষয়ের পাশাপাশি নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সরকারের আমলে রচিত হয় আমাদের জাতীয় সংবিধান; যার বিবিধ ধারার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি ও কাঠামোতে নারী-পুরুষ সাম্য, সম-অধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা হয়। নারী পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য কমিয়ে এনে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনে নারী পুরুষের সমঅংশগ্রহণ ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯৯৭ সালে ঘোষণা করা হয় জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা। ভিশন বা রূপকল্প ২০২১-এর মাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরির রূপরেখা প্রকাশ করা হয়েছিলো। ভিশন ২০২১-এর একটি অন্যতম লক্ষ্য হলো নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীদের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির বাস্তবায়ন, জাতিসংঘ সিডও সনদের বাস্তবায়ন, জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়ন, বৈষম্যমূলক আইন পরিবর্তন করে নারীবান্ধব আইনকানুন চালু, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নারীকে উন্নয়নের মূলধারায় আনার প্রচেষ্টা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও জেন্ডার টার্গেট স্থির করা ইত্যাদি ইতিবাচক উদ্যোগ নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের পথ প্রশস্ত করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে নারীর রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সিদ্ধান্তগ্রহণকারী পদে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি লক্ষণীয়। মানবউন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের উন্নতি ঈর্ষণীয়। এর নেপথ্যে রয়েছে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের উঠে আসার গল্প। তৈরি পোশাকশিল্প, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের দৃপ্ত পদচারণা নিকট অতীতে দৃশ্যমান।
কিন্তু গতবছরের ডিসেম্বরের পর থেকে ভয়াল করোনা ভাইরাসের থাবায় স্থবির সারাবিশে^র মতো বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি নারী-পুরুষের সম্মিলিত অর্জনগুলি থমকে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে গত ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা করোনা মহামারীকালে বেড়েছে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা; হুমকির মুখে পড়েছে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা, গার্মেন্টসকর্মীসহ কর্মজীবী নারীদের জীবন ও জীবিকা; সংকটে পড়েছে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য-শিক্ষা-স্বাবলম্বী হওয়ার সম্ভাবনা। সংকুচিত হয়ে পড়েছে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাÐে অংশগ্রহণ। নারীরা হয়ে পড়ছে দরিদ্রদের মধ্যে দরিদ্রতর। সর্বোপরি নারীর এতোদিনের সংগ্রামে অর্জিত সাফল্যসমূহ ¤øান হয়ে যাবার আশংকা দেখা দিয়েছে। সারাবিশে^ই যেখানে করোনার গ্রাস থেকে মানুষের জীবন এবং অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার প্রবল প্রয়াসে লিপ্ত, সেখানে নারীর ইস্যুগুলি এখন কতোটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে তা নিয়ে সর্বত্রই খানিকটা দ্বিধাদ্ব›দ্ব কাজ করছে। উল্লেখ্য, চলতি ২০২০ সালেই নারী উন্নয়নের আরেক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বেইজিং ঘোষণার ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতিসংঘের যে অধিবেশন হওয়ার কথা ছিলো করোনার কারণে তা খুবই সীমিত আকারে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে সিডও সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে, স্বাক্ষরকারী দেশগুলিকে প্রতি চার বছর পর পর জাতিসংঘের সিডও কমিটির কাছে যে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়, এবছর নভেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের সেটি জমা দেয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে তা খানিকটা অনিশ্চিত।
জাতিসংঘ সিডও কমিটি সরকারকে সুর্নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন, বৈষম্য বিরোধি আইন প্রণয়ন, নারীর উন্নয়নে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা, জনবল, কারিগরি ও আর্থিক সম্পদ নিশ্চিত করা এবং বৈবাহিক ধর্ষণসহ সব ধরনের নারী নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন প্রণয়নের জন্য তাগিদ দিয়েছে। সরকারের দায়িত্ব হলো সিডও কমিটির সুপারিশ তথা সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়নে যথাসম্ভব উদ্যোগ নেয়া। পাশাপাশি নাগরিক সমাজের কাজ হলো সিডও বাস্তবায়নে সরকারের সহায়ক ভূমিকা পালন করা এবং এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি আমাদের দাবি হচ্ছে অবিলম্বে সিডও সনদের দুটি ধারা থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করতে হবে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। করোনা একসময় হয়তো পৃথিবী থেকে নির্মূল করা সম্ভব হবে। কিন্তু এর প্রভাবে নারী-পুরুষের সার্বিক উন্নয়ন অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হলে এবং নারীর এতোদিনের কষ্টার্জিত অর্জনসমূহ ধূলিসাৎ হয়ে গেলে তা হবে এক অপূরণীয় ক্ষতি। এর কুফল আমাদের ভোগ করতে হবে যুগ যুগ ধরে। দেশে নারী-পুরুষ বৈষম্যের মূল উৎপাটন করে নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন ও বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। তাই সকল জাতীয় ও বৈশি^ক সংকটের মাঝখানে দাঁড়িয়েও সরকারকে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে।
(স্টেপস্ টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট একটি বেসরকারি উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংস্থা যা দেশে নারী-পুরুষের সমতা, মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সাল থেকে কাজ করছে)