—– ড. সুফি সাগর সামস্
মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে ঢাকা জেলার সাভার-নবীনগরে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধের মধ্য দিয়ে সকল দেশপ্রেমিক নাগরিক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় ও সাফল্যের যুগলবন্দি রচনা করা হয়েছে। ৭টি ত্রিভুজ আকৃতি মিনারের শিখর দেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ৭টি পর্যায়ের প্রতিটি এক ভাবব্যঞ্জনায় রচনা করা হয়েছে।
এই স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের স্মরণে নিবেদিত এবং শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধার উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধটি সাত জোড়া ত্রিভুজ আকৃতির দেওয়াল নিয়ে গঠিত। দেওয়ালগুলো ছোট থেকে ক্রমশ বড়ক্রমে সাজানো হয়েছে। এই সাত জোড়া দেওয়াল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ধারাবাহিক পর্যায়কে নির্দেশ করে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এই ৭টি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসেবে বিবেচনা করে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।
১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টির পরই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পাকিস্তানের পূর্ব-বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ সাত কোটি মানুষ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তখন থেকেই বাঙালির সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ওপর পাকিস্তানি জান্তাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন তরুন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা করা হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও তরুন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র পূর্ববঙ্গ চষে বেড়ান। যুক্তফ্রন্ট ৩০৯ আসনের মধ্যে ২২৮টি আসন লাভ করে। শাসনতন্ত্র আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ মূলত: বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির অন্তরে স্বাধীনতার অগ্নি প্রজ্জ্বলন করে দিয়েছিলেন। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি শর্ত-সাপেক্ষে স্বাধীনতার আগাম ঘোষণা এবং গেরিলা যুদ্ধের দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হলেন, স্বাধীনতার মহানায়ক।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ৭টি ধারাবাহিক পর্যায়কে পরিক্রমা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক কোথায়? কেন এই পরিক্রমায় মহানায়ককে রাখা হয়নি? তাঁকে না রাখার কারণে মূলত: স্মৃতিসৌধটি ত্রুটিপূর্ণ এবং অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
১৯৭৮ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার আমলেই নকশা আহŸান করা হয়। একই বছর জুন মাসে প্রাপ্ত ৫৭টি নকশার মধ্যে স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন প্রণীত নকশাটি অনুমোদন দেওয়া হয়।
এই নকশার পরিক্রমায় মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাখা হয়নি। বঙ্গবন্ধুবিহীন নকশাটি জেনারেল জিয়া অনুমোদন দিয়েছিলেন। তিনি কী সম্যক জেনে বুঝেই এই নকশা অনুমোদন দিয়েছিলেন? নকশা নির্বাচনে সর্বদলীয় একটি জাতীয় কমিটি গঠন করার দরকার ছিল। এটা করা হলে নক্শা নির্বাচনের বিষয়টি এভাবে ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ হতো না।
প্রতি বছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় দিবস উদযাপন করি। এ দিন দুটিতে জাতীয় স্মৃতিসৌধ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য করে আমরা শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। কিন্তু অতি দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, এই দুটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত!
মুক্তিযুদ্ধের যিনি মহানায়ক, স্বাধীনতার প্রশ্নে যিনি যৌবনের ১৪টি বছর জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন, ২৩টি বছর লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, যিনি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অর্জনের লক্ষ্যে বাঙালি জাতিকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন এবং ঐক্যবদ্ধ করেছেন, সেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় না! একসঙ্গে সমগ্র জাতির শ্রদ্ধা নিবেদনের কোন স্থানও নেই। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে বঙ্গবন্ধু সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ ত্রুটিমুক্ত করতে এবং জাতীয় ঐক্য পুনরায় গড়ে তুলতে ‘জাতীয় স্মৃতিসৌধ’ প্রাঙ্গণে ‘মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, জাতীয় ঐক্যের প্রতীক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর একটি ভাস্কর্য স্থাপন করতে হবে। এটা এই জন্য করতে হবে যে, যাতে সমগ্র জাতি একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেন।
এভাবে যদি একসঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়, তাহলে আমাদের একপক্ষের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যে বিভ্রান্তি ও অমূলক বিদ্বেষ রয়েছে তা ধীরে ধীরে মুছে যাবে। এই জাতীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা একটি ভ্রাতৃত্বময় জাতীয় ঐক্যের পথে অগ্রসর হতে পারবো।
( লেখক, মহাসচিব, বাংলাদেশ হিউম্যানিস্ট পার্টি-বিএইচপি)।