এবার যেন নববর্ষ আর ঈদ একাকার হয়ে গেছে। অন্য বছর পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে বা পহেলা বৈশাখকে ঘিরে যে বেচাকেনা হয় এবার ঈদের কেনাকাটাও যোগ হয়েছে তার সঙ্গে ৷
২০২২ সালে বাংলাদেশ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুঈদ রহমান এক গবেষণা প্রবন্ধে বলেছেন, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে কমপক্ষে পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। তার মতে, দেশের এক কোটি মানুষ আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। তাদের বৈশাখি ভাতার পরিমাণ দুই থেকে ১৬ হাজার টাকা। এই এক কোটি পরিবার সেই ভাতা খরচ করলে তার পরিমাণ হয় তিন হাজার কোটি টাকা। আর গ্রাহকদের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে নববর্ষ বরণ করে এরকম প্রতিষ্ঠান আছে ২৫ হাজার। তারাও গড়ে ১০ হাজার টাকা খরচ করলে তার পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই হিসেবেও পহেলা বৈশাখের অর্থনীতির মোট আকার দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকার।
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এবার করোনামুক্ত পহেলা বৈশাখ, তাই এই আকারটি আরো বড় হওয়ার কথা। কারণ, সাধারণ হিসাবের বাইরে গ্রামীণ অর্থনীতি আছে। যেকোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে সঠিক পরিকল্পনা নিলে অর্থনীতিতে তার ব্যাপক ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়।”
তার কথায়, “পহেলা বৈশাখে দেশীয় পণ্য, কাপড়চোপড়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি থাকে। তাই এটা হতে পারে দেশীয় পণ্যের জন্য একটি সুসময়। এছাড়া, নানা খাদ্যপণ্য ও গ্রামীণ ও শহুরে মেলায় অনেক টাকার লেনদেন হওয়ার কথা।”
তবে তিনি মনে করেন, “পহেলা বৈশাখ নিয়ে গত এক দশক ধরে একটি ধর্মীয় বিতর্ক তৈরির চেষ্টা চলছে। ২০-৩০ বছর আগেও এমন ছিল না। পহেলা বৈশাখ হলো একটি সার্বজনীন উৎসব। তাই এর অর্থনীতিসহ সব ধরনের সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু ওই বিতর্ক বেড়ে গেলে এর সম্ভাবনা কমে যাবে।”
এবার রোজার মধ্যে ঈদের মাত্র কয়েকদিন আগে পহেলা বৈশাখ। ফলে দুইটি উৎসবকে আলাদা বাজেটে রাখেননি অনেকেই। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এবং এফবিসিআইর সাবেক সহ-সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, “সাধারণভাবে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে চার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। কিন্তু এবার রোজার মাসে পহেলা বৈশাখ, আবার সামনেই ঈদ, ফলে দুইটি উৎসব এক হয়ে গেছে।আর দ্রব্যমূল্য অনেক বেশি হওয়ায় মানুষ আগের চেয়ে কম কিনছেন। বাজেট কাটছাঁট করছেন। এবার হয়তবা দুই হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হবে বাংলা নববর্ষে।”
বাংলাদেশে ঈদুল ফিতরে সাধারণভাবে এক লাখ ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। হেলাল উদ্দিন বলেন, “এবার ঈদে এই পরিমাণ লেনদেন না-ও হতে পারে। কারণ, মানুষের খাবার কিনতেই আয়ের প্রায় পুরোটা শেষ হয়ে যায়। ফলে সবাই যে ঈদের পোশাক কিনতে পারবেন, তা বলা যায় না। সবাই কম খরচ করতে চাইছেন।”
ফ্যাশান হাউজ ‘বেণেবউ’ শাড়ি আর বাচ্চাদের পোশাক তৈরি করে। এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা মুনমুন বলেন, “আমাদের বিক্রি ভালোই। তবে যারা কিনছেন, তারা ঈদের পোশাক কিনছেন। পহেলা বৈশাখের জন্য আলাদা করে কিনেছেন অনেক কম মানুষ। দুইটি উৎসব একই সময়ে হওয়ায় হয়তো এরকম হয়েছে।”
তার কথা, “এবার নানা কারণে বাংলা নববর্ষে লোকজন আগের চেয়ে কম বাইরে বের হয়েছেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছি। আগে যেমন ওই এলাকায় তিল ধারণের জায়গা থাকতো না। এবার গিয়ে দেখি তত ভিড় নেই। হতে পারে রোজা আর গরমের কারণে এরকম হয়েছে।”
তবে যেসব ফ্যাশন হাউজ শুধু দেশীয় পোশাক তৈরি করে তাদের পহেলা বৈশাখের বিক্রি ভালো বলে জানা গেছে। ফতুয়া, পাঞ্জাবি আর তাঁতের শাড়ির চাহিদা বেশি। তাদের টার্গেটও থাকে পহেলা বৈশাখ।
রোজার কারণে সকাল বা দুপুরের পান্তা ইলিশ বা অন্যান্য খাবারের আয়োজন নেই এবার। এটাও নববর্ষের বাণিজ্যের বড় একটি খাত। কিন্তু দিন শেষে আয়োজন আছে বলে জানান ‘এনস কিচেন-‘এর সিইও ফাতেমা আবেদিন নাজলা। তিনি বলেন,” এবার ইফতারিতে বাংলা নববর্ষের খাবার আয়োজন করছেন অনেকেই। ইফতারির প্রচলিত আইটেম বাদ দিয়ে নববর্ষের প্রচলিত আইটেমগুলো রেখেছেন। আমরা প্রচুর অর্ডার পেয়েছি হোম ডেলিভারির জন্য। আরো অনেক ক্লাউড শপেরও একই অবস্থা। ”
ঢাকার অনেক হোটেল ও রেষ্টুরেন্ট ইফতারে ও রাতের খাবারে বৈশাখের আয়োজন রেখেছে৷
তবে বাংলা নববর্ষে এবার ইলিশ নিয়ে মাতামাতি কম। কারণ, এখন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। তাই চাইলেও কেউ তাজা ইলিশ পাচ্ছে না। হিমায়িত ইলিশই ভরসা।
— dw.com