‘ওস্তাদ ফজলু’ নামেই বেশি পরিচিত। পুরো নাম হাজি মো: ফজলুল ইসলাম। তবে এ নামে তাকে সচরাচর কেউ চেনার কথা না। পুরোদস্তুর একজন হকি অন্তঃপ্রাণ মানুষ তিনি। স্টিক আর বলের ভালোবাসা ছাড়া ভিন্ন কিছু যেন কল্পনাই করতে পারেন না। সেই যে ছোটবেলায় শুরু-বয়স ৫০ পেরিয়ে গেলেও ছাড়তে পারেননি হকি। নীরবেই কাজ করে যাচ্ছেন পুরান ঢাকার এই কোচ। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পেলেন শেখ কামাল এনএসসি ক্রীড়া পুরস্কার। এর আগে ২০১২ সালে সম্মাননা দিয়েছে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন (বাহফে)। ২০১৬ সালে তৃণমূলে কোচ হিসেবে পুরস্কার দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি (বিএসপিএ)।
দেশের হকিতে সবচেয়ে বেশি খেলোয়াড় সরবরাহ করেছে আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। এক সময় ফরিদপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ থেকে অনেক খেলোয়াড় উঠে এলেও এখন সেটি একপ্রকার বন্ধ। বর্তমানে হকি শাষন করছে বিকেএসপি। তবে তৃণমূলে ওস্তাদের ধারে কাছে নেই। অথচ তার প্রতিদিনের সংসার কিভাবে চলবে সে হিসাব নেই। একবার এক সংবর্ধনার পর আক্ষেপ করে একবার বলেছিলেন, মাঠে থেকে যতক্ষণ অনুশীলন করাই ততক্ষণ ভালো থাকি। ঘরে গেলেই শুনতে হয় এটা নেই, ওটা নেই। ট্রফি দিয়ে কি করব। আমার যে সংসার চলে না।
গতকাল শেখ কামাল পুরস্কারের পর ওস্তাদ জানালেন, ‘স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশ এশিয়া কাপ জিতবে। ক্রিকেটের মতো প্রফেশনাল হবে। খেলোয়াড়দের বেতন থাকবে, বোনাস থাকবে। আল্লাহর রহমতে আমার নিজের সংসার কোনোমতে চলে যাচ্ছে। আমি চাই প্রতিটা হকি খেলোয়াড় যেন অর্থকষ্টে না ভোগে।’
পুরস্কারের এক লাখ টাকা দিয়ে কি করবেন। জানতে চাইলে ওস্তাদ বলেন, ‘কিছু দেনা পরিশোধ করব। ঘরে ফ্রিজ ও টিভি আনব। মেয়েটা অনেকদিন থেকেই টিভির জন্য কান্নাকাটি করেছে। আমাকে যারা ভালোবাসে তাদেকে মিষ্টিমুখ করাব ইনশ আল্লাহ।’
এশিয়া কাপে বাংলাদেশ হকি দলের অপরিহার্য চার খেলোয়াড় রাসেল মাহমুদ জিমি (অধিনায়ক), নাঈম উদ্দিন, মো: আরশাদ ও ইমরান হাসান ওস্তাদ ফজলুর হাত ধরেই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন। তবে শুধু এই চারজনই নন, ফজলুর হাত ধরে জাতীয় দল ও যুব দলে নাম লিখিয়েছেন ২৪ জনের মতো খেলোয়াড়।
পুরান ঢাকার বেগম বাজারের গলি পেরিয়ে সামনে এগোতেই ওস্তাদ ফজলুর বাড়ি। বাড়ির ছাদে শখ করে সবাই বাগান করে; কিন্তু করোনাকালীন সময়ে তিনি এমনভাবে ছাদকে সাজিয়েছেন, যেন মিনি হকি মাঠ। ছাদবাগানের জায়গায় করেছেন ছাদহকি। করোনার বিস্তারের সময় স্কুল ও খেলার মাঠ বন্ধ হয়ে গেলে নিজেকে এবং শিষ্যদের ফিট রাখতে এই ছাদহকির কল্পনা এবং বাস্তবায়ন। যেটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে জাতীয় পুরস্কারে।
পুরস্কার পাওয়ার পর বারবারই স্মরণ করলেন তার ওস্তাদ, বর্তমান হকির সেনসেশন রাসেল মাহমুদ জিমির বাবা আবদুর রাজ্জাক সোনা মিয়ার কথা। ‘শুরুতে হকিস্টিক, বল কিংবা জার্সি কিছুই ছিল না। ওস্তাদ দু’টি ভাঙা হকিস্টিক দিয়ে বলেছিলেন, জোড়া দিয়ে খেল, কষ্ট কর, তাহলে দেখবি খেলাটির প্রতি ভালোবাসা জন্মেছে। আরমানিটোলা স্কুল দলকে তিনবার চ্যাম্পিয়ন করিয়েছি। এরপর সরাসরি প্রথম বিভাগের ক্লাব পিডব্লিউডিতে খেলার সুযোগ করে দেন ওস্তাদ সোনা মিয়া। মজার বিষয় হলো ওস্তাদের ছেলে জিমির খেলা শুরু আমার হাত ধরেই।’ তিনি যোগ করেন, ‘আমার শিষ্য মডেল ও সাবেক হকি খেলোয়াড় ফয়সাল আহসান উল্লাহ বিপদ আপদে সবসময় এগিয়ে আসে। এ ছাড়া আরো কয়েকজন আছেন খোঁজখবর রাখেন।’
‘ফজলু ওস্তাদের মুখের বুলি, চলো সবাই হকি খেলি’- পুরান ঢাকার পাড়া-মহল্লায় এ স্লোগান সবার জানা। অনটনের মধ্যেই দিন কাটে ফজলুর; কিন্তু শেখাতে তিনি কোনো অর্থও নেন না। উল্টো জার্সি-জুতা কিনে কিংবা সিনিয়দের থেকে নিয়ে গরিব ছেলেমেয়েদের দেন। নিজ হাতে সেলাই করে দেন শিষ্যদের ছেঁড়া ফাড়া কেডস।
ফজলু ১৯৮৪ সালে সুযোগ পান জুনিয়রদের জাতীয় দলে খেলার। লিগে ভিক্টোরিয়া বনাম ঊষার খেলায় ৭ মিনিট আগে চোখের ওপর স্টিকের আঘাত পেলে ১৩টা সেলাই দিতে হয়। এরপর জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপাতে পারেননি। স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটলে দুঃখ ঘোচাতে কোচিংয়ের স্বপ্ন শুরু সেখানেই। নিজের জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন শিষ্যদের দিয়েই পূরণ করেছেন। আশির দশকে যে স্বপ্নের শুরু, সেটি এখনো চলমান। তার অ্যাকাডেমির ছাত্ররাই ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে খেলে থাকেন।
২০১৬ সালে হঠাৎই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় ফজলুর। তিন দিন কোনো জ্ঞানই ছিল না তার। নতুন জীবন পেয়ে আরো বেশি আগ্রহী হন খেলোয়াড় তৈরিতে। রফিকুল ইসলাম কামাল, রাসেল মাহমুদ জিমি ও তার ভাই রাকিন মাহমুদ, মাকসুদুল আলম হাবুল, নাঈম উদ্দিন, আরশাদ হোসেন, শওকত হোসেন, ইকবাল নাদের প্রিন্স, ফয়সাল, আবদুস সাজ্জাদ জন, মামুন, রাজীব, সুমন, ইমরান, রনি, লিটন সরাসরি ওস্তাদ ফজলুর ছাত্র। সিনিয়রদের মধ্যে- কামাল, ফয়সাল আহসানউল্লাহ, তারেক আদেল, আবেদ, তারা, এহতেশাম, কায়সার ও নাসির। ছাদহকির আবিষ্কার সানাফ। ওস্তাদ জানালেন, ‘আগামীর তারকা হবে সানাফ।’
১৯৬৭ সালে জন্ম নিলেও ২০১০ সালে ৪৩ পেরিয়ে বিয়ে করেন। একবার জীবিকার তাগিদে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। সেখানে হকির চর্চা নেই বিধায় ৬ মাস পর চলে এসেছেন।