বাংলাদেশের কোন জায়গায় গিয়ে আপনি বুঝতে পারবেন যে, এখানে করোনাভাইরাস মহামারি এসেছিল বা এখনও আছে? গুলিস্তান ও সদরঘাট ইতোমধ্যেই তার পুরনো চেহারায় ফিরে এসেছে। নিউমার্কেটে যান, দেখবেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা তো দূরে থাক, ভীড়ের মাত্রা যেন আগের চেয়ে অনেক বেশি।মানুষ গিজগিজ করছে সর্বত্র।শফি হুজুরের জানাজায় লাখো মানুষের সমাগম হলো। কোথাও দেখা যায়নি স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা।গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলোতে সকালে সেই চিরচেনা দৃশ্য। বাস, রেল, স্টিমার, বিমানবন্দর কোথাও নেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বালাই।শুধু নিউমার্কেট নয়, সকল মার্কেটেই লোকসমাগমের দৃশ্য দেখলে মনে হবে না যে, বাংলাদেশে করোনা আছে। তবে কেনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে? কোন বৃহত্তর স্বার্থে?
পড়ালেখা বন্ধ রেখে মিড ডে মিলের নামে বিদেশ ভ্রমনের সুযোগ তৈরির প্রজেক্ট করতে গিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন।অথচ শিক্ষকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিশেষ করে, কিন্ডারগার্টেন স্কুলে কর্মরত লক্ষ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারী সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থেকে এখনও বঞ্চিত মন্ত্রণালয়ের একটুখানি উদ্যোগের অভাবে।মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট একটা বরাদ্দ চেয়ে সারসংক্ষেপ দিলেই হয়তো বঞ্চিত শিক্ষকগণ আত্মহত্যা বা পেশা পরিবর্তন বা স্কুল বন্ধ করে দেয়ার মতো রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর ও নেতিবাচক কোনো পথে পা বাড়াতেন না।একজন ভাষাসৈনিকের সন্তান হিসেবে আমি হলফ করে বলতে পারি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসলে তিনি সেটাকে ইতিবাচকভাবে নিতেন এবং শিক্ষকদের জন্য একটা সম্মানজনক বরাদ্দ দিতেন। কিন্তু কতৃপক্ষীয় নজিরবিহীন উদাসীনতার কারণে সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নে নিয়োজিত শিক্ষকরা যেমন বঞ্চিত হয়েছেন, তেমনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ‘চাকুরির পিছনে না ঘুরে উদ্যোক্তা হও’ এই মন্ত্রে দীক্ষিতরা হয়েছেন দারুণভাবে নিরুৎসাহিত। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে দেশের আনাচে কানাচে গড়ে ওঠা হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালকদের। ১ লক্ষ ১২ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা প্রণোদনা বরাদ্দ দেয়া হলো। কেনো একটি টাকাও শিক্ষকদের ভাগ্যে জুটলো না? এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবেন? তাদের অবস্থান কি রাষ্ট্রের কাছে রোহিঙ্গাদের চেয়েও খারাপ? মনে রাখতে হবে, শিক্ষকরা ভিক্ষুক নন।তারা আত্মমর্যাদায় বিশ্বাসী। তারা অন্যদের মত হাত পাততে পারেন না। তাই তাদের বঞ্চনা, কষ্ট ও বেদনা অনুধাবন করতে হবে হবে বিশেষ সংবেদনশীলতা ও অনুভূতিসম্পন্ন গুণ দিয়ে।
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড হলেও আমাদের দেশের শিক্ষার মেরুদন্ড করোনা মহামারিতে অনেকটা ভেঙ্গে গেছে। পৃথিবীর সকল উন্নত দেশে এখন স্কুল খোলা। তারা কি আমাদের চেয়ে গর্দভ? এ প্রশ্নটি করেছেন সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান (এনআই খান)।তিনি সম্প্রতি একাত্তর টিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্কুল খোলার উপর গুরুত্বারোপ করে জানান, পুরনো ঢাকায় ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য কিনতে গিয়ে তিনি যা দেখেছেন, তাতে তো মনে হয় না দেশে করোনা আছে।তিনি স্ট্যাটিসটিকস তুলে ধরে বলেন, লেখাপড়া চলতে হবে।গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদরাসাগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা অনেক কম। সেখানে দু’তিন শিফটে প্রতিষ্ঠান চলতে পারে।এদিকে ১ অক্টোবর থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিলের দায়িত্বে ‘এ’ এবং ‘ও’ লেভেল পরীক্ষার অনুমতি দেয়া হয়েছে। মাদরাসা খোলার অনুমতি দেয়া হয়েছে অনেকদিন হলো।মাদরাসায় কোথাও কোনো সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি।তবে কেনো বাকী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকবে?
লালসালু উপন্যাসে যেমন প্রসঙ্গ এড়াতে বলা হয়, ‘তোমার দাঁড়ি কই মিয়া’? তেমনি হয়তো বলতে পারবেন, একাধিক সংগঠন, বহু স্মারকলিপি, ভিন্ন ভিন্ন দাবী-দাওয়া, কোনটি শুনব? উত্তর হলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক সংক্রান্ত যে তথ্য আছে, সেই তথ্য অনুযায়ী একটি বাজেট করলেই তো হয়।তদুপরি গত ১৫ সেপ্টেম্বর কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে নিয়ে কাজ করেন এমন বৃহৎ ১৮টি সংগঠনের যৌথসভায় জাতীয় কমিটি করার প্রস্তাব এসেছে। সেদিন প্রত্যেক শিক্ষককে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যৌথভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা চাওয়া হয়েছে।পত্র পত্রিকায় এসেছে।আমরা যা চাই, তা হয়তো সরকার দেবেন না।সেজন্য আমরা আমাদের মত করে চেয়েছি।সরকার তার মত করে সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রয়োজনে আমাদেরকে ডাকলে আমাদের নেতৃবৃন্দ যাবেন।পরামর্শ হতে পারে।কিন্তু শিক্ষকদেরকে একেবারে বঞ্চিত করার চেষ্টা মেনে নেয়া যায় না।তারা তো এদেশেরই নাগরিক। সাংবাদিক, কবি সাহিত্যিকসহ সবাই যখন প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা পেলো, কেনো শিক্ষকরা বঞ্চিত থাকবেন? তাহলে তো প্রশ্ন আসবেই, তারা কি কোনো ভিন গ্রহ থেকে আসা কেউ? তাদের সাথে এমন বিমাতাসুলভ আচরণ কেনো? মাননীয় তথ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের জন্য আর্থিক সহায়তার বরাদ্দ আনতে পারলে, মাননীয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী শিক্ষকদের জন্য তা পারবেন না কেনো? নাকি কিন্ডারগার্টেনের সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষার ফলাফল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় অনেক ভালো হয়, এটাই তাদের অপরাধ? মানসম্মত পাঠদান করাই কি তাদের অপরাধ?
সবাই জানেন, কিন্ডারগার্টেনগুলোর বেশিরভাগই ভাড়া বাড়িতে।গত ৮ মাসে আয় বন্ধ কিন্তু ভাড়া তো বন্ধ নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে গত আট মাসের বেতন পায়নি বললেই চলে।একেবারে নিরুপায় হয়ে তিনজন শিক্ষক আত্মহত্যা করেছেন।অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন।ভাড়া দিতে না পেরে কেউ আবার বিদ্যালয় বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছেন।‘স্কুল বিক্রি হচ্ছে’ বিজ্ঞাপনটি শিক্ষাসচেতন মানুষের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করলেও গলেনি এই সেক্টরের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তাব্যক্তিদের হৃদয়।আর্থিক সহায়তা করতে পারেননি সমস্যা নেই। ঘর ভাঙলেও মন ভাঙেনি যাদের, সেই শিক্ষকরা এখন নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে বিদ্যালয় পরিচালনা করতে আগ্রহী। যেহেতু শিক্ষার্থী কম, সেহেতু শিফট ভাগ করে সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস করালেও শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা অনেকটা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব। দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে। কেউবা ভার্চুয়াল জগতের অন্ধ প্রকোষ্টে প্রবেশ করছে, বিপথগামী হচ্ছে এবং তাদের অনেককে হয়তো আর সারা জীবনের জন্য পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে আনাই যাবে না।তাই কিন্ডারগার্টেনে অধ্যয়নরত কোটি শিক্ষার্থীসহ সকল শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত নিয়ে দুরদর্শী ও টেকসই পরিকল্পনা করা দরকার।
একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিভিন্ন গণমাধ্যমে অসহায় কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের পাশে থাকার জন্য সরকারকে আহবান করেছেন এবং বিদ্যালয় খোলে দেওয়াসহ বিভিন্ন দাবীতে জাতীয় পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। যেমন : গত ২৭ জুন ‘শিক্ষকরা পেশা বদলাচ্ছেন’ শিরোনামে দৈনিক সমকালে লিখেছেন জাতীয় অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ১৫ সেপ্টেম্বর ‘এক কোটি শিক্ষার্থীর দায় কে নেবে? শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে লিখেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ। কেনো তারপরও শিক্ষকরা সরকারের আর্থিক সহায়তা পাবেন না এবং স্কুল খোলা হবে না? বিদ্যালয় বন্ধ থাকলে কার লাভ? এখন যে সংক্রমণের আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে, সেটা আবার বাঙ্গালকে হাইকোর্ট দেখানোর মতো কিনা তাও ভাবতে হবে। বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও যারা সরকারি বেতন পান, এটি তাদের অভিলাষ কি না এমন আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। তাদের মতে, সরকারি বেতন বন্ধ রাখুন, দেখবেন স্কুল বন্ধ রাখার কথা তারা একবারও বলবেন না। আসলেই কি এরকম কিছু? আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। এদিকে ২৯ সেপ্টেম্বর শিগগিরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ও এইচএসসি পরীক্ষা বিষয়ে জানানো হবে বললেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক।
আরেকটি বিষয় বলা ভালো, যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন দেশে করোনা সংক্রমণের পরিমান খুবই কম। মৃত্যু সংখ্যা বিশ থেকে ত্রিশের কোটায়।কোনো মৃত্যুই আমাদের কাম্য নয়।তবে রেস্যিউ বলে একটি কথা আছে। অন্য অনেক সাধারণ কারণে মৃত্যুর সংখ্যা দৈনিক শতাধিক হলেও কোন বিবেচনায় এমন ভালো পরিবেশে কেবলমাত্র জুঁজুঁর ভয় দেখিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে পূর্বের ন্যায় পাঠোভ্যাসে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা রহিতকরণ, আমাদের জানা নেই।
লিখেছেন:
মোহাম্মদ আবদুল অদুদ৷ সাংবাদিক ও প্রধান সমন্বয়কারী, কিন্ডারগার্টেন ও সমমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রক্ষা জাতীয় কমিটি