— মোঃ সহিদুল ইসলাম
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ এর “কোন এক মাকে” কবিতার মধ্যে একুশের ইতিহাস সুস্পষ্ট :
মাগো, ওরা বলে সবার কথা কেড়ে নেবে।
তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না।
বলো, মা, তাই কি হয়?
বাংলা মায়ের মুখের ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে বাংলার সন্তানেরা বুকে তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে পিচের কালো রাস্তাকে রঙিন করে যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। ২১শে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় ঐতিহাসিক দলিল। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ে আন্দোলনের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বের সামনে এক উদাহরণ।
ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল মূলত: ১৯৪৮ সালে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব নাকচ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার রাজপথে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা। অতঃপর ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এসে এ আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছিল।
১৯৪৮ সালের ২১ শে মার্চ পাকিস্তানেরক জনসভায় ঘোষণা করেন “Urdu only and Urdu shall be the state language of Pakistan”. পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালের ৩০ শে জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্বোক্ত ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করেন, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু”। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণ তথা আরবিকরণের অংশ হিসাবে ঘোষণা করেন যে “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা” ফলে পূর্ব বাংলার (প্রায় ৫৪%) বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে মাতৃভাষা বাংলার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু এর প্রতিবাদে সমগ্র ছাত্র সমাজ উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়।
সংগ্রাম পরিষদ সমগ্র পূর্ব বাংলায় ২১শে ফেব্রুয়ারি “রাষ্ট্রভাষা দিবস” পালন করলে সমগ্র ছাত্র-জনতার মাঝে অভূতপূর্ব সারা জাগে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শুধুমাত্র উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত। এছাড়া ঐদিন ১৭ জন ছাত্রজনতা আহত হন। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার ইতিহাস বা নজির এটিই প্রথম। সেদিন দুঃখিনী বর্ণমালা বা বাংলা ভাষা, মায়ের ভাষা ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি এভাবে আন্দোলন, সংগ্রামের মাধ্যমে শৃংখলমুক্ত হয়েছিল। ২২ ও ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র- শিক্ষক, কবি- সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল, সভা, শোভাযাত্রাসহ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। সেদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামের এক কিশোর। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণ ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার।
বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি নকশা করেন স্থপতি হামিদুর রহমান। প্রতিবছরে ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাঙালিরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা এর পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তক অর্পণ শেষে সেখানে কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থেকে মহান ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনসহ মাগফেরাত কামনা করেন। পরবর্তীতে সর্বস্তরের জনগণ স্ফূর্তভাবে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের সঙ্গে হৃদয় থেকে উপলব্ধি করে আব্দুল গাফফার চৌধুরী অনন্য এক গান সর্বত্র ধ্বনিত হয়- “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি”।
১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) এর সাধারণ পরিষদ এর ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থনে সর্বসম্মতভাবে ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বব্যাপী প্রথম পালিত হয় “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”। বিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে একুশ শতকের প্রথমদিকে বাঙালির পক্ষে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় সুসংবাদ। যাঁদের জন্য আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রথম পাদ্য তাঁরা আজ আর কেউ এই পৃথিবীতে নেই। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি একুশের এই অনন্য বিশ্বস্বীকৃত অর্জনের নেপথ্যে মাতৃভাষা প্রেমিক বাঙালি যাঁরা অবদান রেখেছে তাঁদের প্রতি। কৃতজ্ঞতা জানাই “লাভার্স অফ দ্য মাদার্স ল্যাংগুয়েজ ক্লাব” (মাতৃভাষা শ্রেণী সংগঠন) এর দুই প্রবাসী বাঙালি শ্রদ্ধেয় রফিক ও সালামকে। সেইসঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানাই ইউনেস্কোসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে।
মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য উল্লেখ করে ভাষাবিজ্ঞানী ড: হুমায়ুন আজাদ বলেছেন:- ‘আমি মুগ্ধ, আমি প্রীত, আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, আমার প্রাণের কথা আমার ভাষায় জানাতে পারবো বলে আমার হৃদয় স্পন্দন বেড়েছে। সত্যিই গর্বিত আমি’।
(লেখক একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা)।