আগামী ৯-১০ সেপ্টেম্বর, বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র প্রধানরা বার্ষিক জি২০ শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে ভারতে একত্রিত হতে যাচ্ছেন। ভারত ১লা ডিসেম্বর ২০২২ এ এক বছরের জন্য সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে। ইন্দোনেশিয়ায় পূর্ববর্তী বার্ষিক সম্মেলনে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশ্ব নেতাদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ভারত তার জি২০ সভাপতিত্বে সক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, উচ্চাভিলাষী এবং কর্মমুখী নীতির অনুসরণ করবে। এরই প্রেক্ষিতে, ভারত তার প্রাচীন সংস্কৃতি নীতিতে নিহিত “বসুধৈব কুটুম্বকম” অর্থাৎ ” এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ” থিমটি বেছে নিয়েছে। এই থিমটি সামগ্রিক বিকাশ প্রক্রিয়ায় সকল জীবের একাত্মতার এবং আমাদের পৃথিবীকে রক্ষা করার অপরিহার্যতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এর স্থায়িত্ব বৃদ্ধির উপর জোর দেয়।
জনাব মোদী এই শীর্ষ সম্মেলনকে মহামারী পরবর্তী বিশ্বের জন্য “জনগণের জি২০” হিসাবে ঘোষণা করেছেন এবং তিনি খাদ্য ও জ্বালানি সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক গুলো শক্তিশালী করন, অন্তর্ভুক্তি মূলক অর্থনীতি, ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই প্রবৃদ্ধি, ডিজিটাল পাবলিক অবকাঠামো এবং জলবায়ু অর্থায়নের উপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। বৈশ্বিক রাজনীতি এবং গতিশীল অর্থনীতির পরিমণ্ডলে এই শীর্ষ সম্মেলনটি ভারতের জন্য বিশ্বমঞ্চে তার অবস্থান পুনঃমূল্যায়ন করার একটি অনন্য সুযোগ প্রদান করেছে। যার মাধ্যমে ভারত তার প্রভাব, বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবেলায় এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উপর মতামত প্রদর্শনের সুযোগ পাবে। যাই হোক, এই সম্মেলন ভারতের জন্য একটি বড় সুযোগ হওয়ার পাশাপাশি এটি অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জও ছোড়ে দিয়েছে।
১৯৯৯ সালে যখন বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কবলে তখনই গঠিত হয়েছিল গ্রুপ অব টুয়েন্টি বা জি২০। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি মূলত সদস্য রাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের একটি সভা ছিল। সবার লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক অর্থনীতি ও আর্থিক সংকট সমাধানের জন্য কার্যকরী নীতিমালা প্রণয়ন করা। বর্তমানে এই ফোরামের শীর্ষ সম্মেলনে প্রতিটি সদস্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্যান্য উচ্চ পদস্থ আমলারা অংশ নিয়ে থাকেন। মূলত বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান খুঁজে পেতে জি-৭ দেশগুলোর অক্ষমতা নিয়ে আন্তর্জাতিক অসন্তোষ থেকে জি২০ গঠিত হয়েছে। জি২০ বিশ্বের প্রধান প্রধান উন্নত এবং উদীয়মান ১৯ টি দেশ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এর পাশাপাশি, ৯ টি অতিথি দেশ এবং ১৪ টি বহুপাক্ষিক সংস্থা অংশ গ্রহণ করে। এই শক্তিধর গোষ্ঠীটি বিশ্বের জনসংখ্যার ৬৫%, বিশ্ববাণিজ্যের ৭৯%এবং বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৮৫% প্রতিনিধিত্ব করে।
নিরাপত্তা পরিষদে দুই বছরের মেয়াদ কাল, সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের সভাপতিত্ব, চলমান জি২০ এর সভাপতিত্ব, এমনকি একটি সফল চন্দ্র অবতরণের ফলে ভারতের কূটনীতি এবং ভাবমূর্তি এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এটা জোর দিয়ে বলা ন্যায় সঙ্গত হবে যে, ভারতের সভাপতিত্বে বছরব্যাপী জি২০ সম্মেলন যেভাবে আড়ম্বরপূর্ণ করে অনুষ্ঠিত হয়েছে তা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। এরূপ দর্শনীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে ভারত বিশ্বমঞ্চে একটি প্রভাবশালী জাতি ও “গণতন্ত্রের মাতা ” উপাধি অর্জন করেছে।
ভারত এমন এক জটিল সন্ধিক্ষণে জি২০ এর সভাপতিত্ব গ্রহণ করেছে যখন বিশ্ব সম্মিলিতভাবে মহামারী বিপর্যয় এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব থেকে পুনরুদ্ধার এর চেষ্টা করছে। দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকেই মোদির প্রতিশ্রুত ‘জনগণের জি২০’ এর অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম সুস্পষ্ট ছিল। ভারতের সভাপতিত্বে বছরব্যাপী ১১ টি এনগেজমেন্ট গ্রুপ, শেরপা ট্র্যাকের অধীনে ১২ টি ওয়ার্কিং গ্রুপ ও ৮ টি ফিনান্স গ্রুপের মাধ্যমে মন্ত্রী, আমলা, এবং সুশীল সমাজের সদস্যদের সাথে ২০০ টি বৈঠকের আয়োজন করেছে। পাশাপাশি, এই বৈঠকগুলো কেবল রাজধানীতে সীমাবদ্ধ না রেখে এটি দেশের ৫০ টি শহরে ও ৩২ টি বিভিন্ন কর্মধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তরুণদেরকেও যুক্ত করেছে। ভারত কৌশলগতভাবে যোগ, আয়ুর্বেদ, বলিউড এবং ক্রিকেট ব্যবহার করে তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে এবং জি২০ এর প্রতিনিধি ও অতিথিদের কে ভারতের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বৈচিত্র্য, প্রাণবন্ততা এবং আতিথিয়তায় মুগ্ধ করে নিজেকে বিশ্ব নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে তার ‘নরম শক্তি’ ব্যবহার করছে।
বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ভারতের নেতৃত্ব কে অবশ্যই তার অভ্যন্তরীণ সমস্যার পাশাপাশি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোও সাবধানতার সাথে পুনঃ বিবেচনা করতে হবে। ভারতের অভ্যন্তরীণভাবে, মণিপুরে অশান্তি এবং হরিয়ানা রাজ্যের নূহ এবং গুরুগ্রাম জেলায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকরী পদক্ষেপ ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। উপরন্ত, ভারত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অন্যান্য জি২০ সদস্য এবং অংশীদারের স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গির ভারসাম্য রক্ষার মতো জটিল কাজের মুখোমুখি।
জি২০ সদস্য রাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন উন্নয়নমূলক অবস্থা, শাসন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য, কর ব্যবস্থা, ডিজিটাল অর্থনীতি, স্বাস্থ্য এবং উন্নয়নের মত সঞ্চালনশীল বিষয়গুলিতে ঐক্যমত হওয়া ভারতের সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ। রাশিয়া -ইউক্রেন সংঘাত আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে, রাশিয়া সাথে ভারতের ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার কৌশলগত অংশীদারিত্বের কারণে ভারতের অবস্থান বেশ জটিল করে তুলেছে। বিশ্ব নেতারা এই সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
ভারত অর্থনৈতিক মন্দা, ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক দারিদ্র্য, এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে পড়ার আসন্ন প্রতিক্রিয়া স্বীকার করে। খাদ্য, জ্বালানি ও সার সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব এবং তদসংশ্লিষ্ট নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ গুলিকে মোকাবেলা করে ভারতকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ঘোষণা তৈরি করতে হবে। বহুপাক্ষীক উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান, বৈশ্বিক মূল্যস্ফিতি, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষুদ্র অর্থনীতি এর নীতিমালা প্রণয়ন করা ভারতের সামনে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এছাড়াও নয়া দিল্লির নীতিনির্ধারকগণ ভূ- রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে নিরপেক্ষতার মত কঠিন এবং জটিল পথ বেছে নিয়েছে যা এই দ্বিধাবিভক্ত বিশ্ব নেতাদের সামনে ভারতকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব তার বিশ্ব শক্তি মর্যাদা অর্জনের পথ প্রশস্ত করবে। ভারত জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে নিজেদের পদচিহ্ন রেখে যাওয়ার জন্য কিছু ভিন্ন ধর্মী পরিকল্পনা চালু করেছে। যেমন- আসন্ন শীর্ষ সম্মেলনে আফ্রিকান ইউনিয়নের সদস্যপদ প্রাপ্তির জন্য প্রস্তাবনা করেছে। ভারত তার সমৃদ্ধ প্রাচীন এবং টেকসই পরিবেশবান্ধব ঐতিহ্যগুলোকে বাজার ভিত্তিক প্রচারণার ফলে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। সবুজ প্রবৃদ্ধি প্রচারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়ন, প্রযুক্তি এবং ন্যায় সঙ্গত জ্বালানি সরবরাহ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ভারত এই সম্মেলনে গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব অর্জনে এবং পক্ষে কথা বলার সুবর্ণ সুযোগ পাবে। এই সমস্ত পদক্ষেপ গুলো ভারত কে একটি প্রভাবশালী জাতি হিসেবে বিশ্ব মঞ্চে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ করে দিবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই জি২০ সম্মেলনে ভারতের সকল পদক্ষেপ ঘনিষ্ঠ ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। এই সম্মেলন ভারতের জন্য ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দেশ হিসাবে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে নেতৃত্ব দেওয়ার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সেই সাথে ভারতের আঞ্চলিক বাধ্যবাধকতা অবহেলা করলে এর গ্রহণযোগ্যতা বিপন্ন হতে পারে। আসন্ন জি২০ সম্মেলন দ্রুত পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভারতের অবস্থানের জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা সরূপ। ভারতকে নিশ্চিত করতে হবে যে তার সভাপতিত্ব কেবল কার্যকরীই নয় আসন্ন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাকে মোকাবেলা করে যুগান্তরকারীও বটে।
—————————————————————————–
এম এ হোসাইন একজন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
——————————————————————————-