— এম এ হোসাইন
গত ১৩ই সেপ্টেম্বর, উত্তর কোরিয়ার নেতা চেয়ারম্যান কিম জং উন বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস সংকট পরবর্তী তার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ শুরু করেন। রাশিয়ার সুদূর পূর্বের আমুর ওব্লাষ্টে অবস্থিত ভোস্টোচনি কসমোড্রোম স্পেসপোর্টে তার বুলেটপ্রুফ ট্রেন থেকে অবতরণের মাধ্যমে আগমন নিশ্চিত হয়। পিয়ংইয়ং থেকে বয়ে নিয়ে আসা কিমের ব্যক্তিগত লিমোজিনে প্রেসিডেন্ট পুতিন ও কিমের ঘন্টা ব্যাপী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, পরবর্তীতে দুই রাষ্ট্রপ্রধান একসাথে লঞ্চিং ভেহিক্যাল অ্যাসেম্বলি বিল্ডিং এবং স্পেসপোর্টের বিভিন্ন অংশ পরিদর্শন করেন। পুতিন এই বৈঠকে কোরিয়ান যুদ্ধের সময় উত্তর কোরিয়ার প্রতি রাশিয়ার তৎকালীন সমর্থন স্মরণ করেন এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে মানবিক সমস্যা ও আঞ্চলিক গতিশীলতার বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। কিম ফলশ্রুতিতে, চলমান ইউক্রেন সংঘাতে মস্কোর প্রতি “পূর্ণ এবং নিঃস্বার্থ সমর্থন” এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিমের এই ভ্রমণসূচিতে কমসোমলস্ক -অন- আমুরে অবস্থিত উড়োজাহাজ কারখানা, ভ্লাদিভসটকের একটি সামুদ্রিক জীব গবেষণাগার এবং রাশিয়ার প্যাসিফিক নৌবহর পরিদর্শন অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই দ্বিপাক্ষিক সম্মেলনটি নিঃসন্দেহে “কৌশলগত তাৎপর্যপূর্ণ” এবং বিশেষ করে মার্কিন ও পশ্চিমা বিরোধী জোটকে শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভিয়েতনামের হ্যানয়ে কিম এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে ব্যর্থ শীর্ষ বৈঠকের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ কোরিয়া সাথে উত্তর কোরিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্কের স্থবিরতার পটভূমিতে এই কিম-পুতিন বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হলো। এরই প্রেক্ষিতে, পরাশক্তিধর পুতিনের সাথে বৈঠকটি কিমের জন্য একটি ব্যাপক কূটনৈতিক সাফল্য এবং উত্তর কোরিয়াকে বৈশ্বিক মঞ্চে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার কৌশলগত পদক্ষেপ হিসাবে দেখা হচ্ছে। মস্কো এবং পিয়ংইয়ং এর মধ্যকার সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে, যখন স্ট্যালিন ১৯৫০ সালে কুরিয়ান যুদ্ধের সময় কিমের দাদাকে সমর্থন করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০২২ সালের মার্চ মাসে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের একটি প্রস্তাবের বিরোধিতাকারী পাঁচটি দেশের মধ্যে উত্তর কোরিয়া একটি ছিল। শুধু তাই নয়, পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার দখলকৃত ডোনেস্ক ও লুহাস্ক অঞ্চলকে স্বাধীনতার স্বীকৃতিদানকারী তিনটি দেশের একটি উত্তর কোরিয়া। উত্তর কোরিয়ার সোভিয়েত ডিজাইনকৃত আর্টিলারি গোলা এবং রকেট এর মজুদ ও উৎপাদন রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর জন্য একটি সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হতে পারে। তার বিনিময়ে, কিম পুতিনের কাছ থেকে যে সকল সহায়তা পেতে পারেন তা হল খাদ্য, জ্বালানি, এবং উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র যা আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র, পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র, এবং সামরিক গোয়েন্দা স্যাটেলাইট অন্তর্ভুক্ত। এই বিনিময় চুক্তিবদ্ধ হলে ইউরোপিয়ান এবং এশিয়ান অঞ্চল কে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বলে কে আরো জটিল করে তুলবে।
কিম তার সফরের সময় পুতিনকে “কমরেড পুতিন” আখ্যায়িত করে ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং ইউক্রেনের রাশিয়ার পদক্ষেপ কে “তার সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার রক্ষার জন্য একটি পবিত্র সংগ্রাম” হিসাবে চিহ্নিত করেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধে ভবিষ্যতে এই দুই দেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। রাশিয়ার কসমোড্রোমে তাদের বৈঠকের একটি অন্তর্নিহিত তাৎপর্য রয়েছে যখন অতি সম্প্রতি উত্তর কোরিয়া তার সামরিক গোয়েন্দা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দুইবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এই বৈঠকে রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত সোভিয়েত মডেলের আর্টিলারি ও রকেট লাঞ্চারের গোলা ও রকেট সরবরাহ পেতে পারে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। বৃটেনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট এর একজন সিনিয়র রিসার্চ ফেলোর তথ্যানুসারে, রাশিয়া গত বছর ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ১১ মিলিয়ন গোলা ব্যয় করেছে এবং এ বছর আরো ৭ মিলিয়ন গুলা ব্যবহার করার প্রত্যাশা করছে। রাশিয়ার সমরাস্ত্র কারখানা গোলা উৎপাদন বৃদ্ধি করার পরও তা যুদ্ধের তীব্রতার তুলনায় প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার কাছে রাশিয়ার প্রয়োজনীয় গোলা ও রকেটের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। টিমের সফর সঙ্গী হিসেবে শাসকদলের একজন কর্মকর্তা, জো চুন রিয়ং কে দেখা গেছে, যিনি উত্তর কোরিয়ার গোলাবারুদনীতির তত্ত্বাবধান করেন।
রাশিয়ার জন্য বিশেষ আগ্রহের বিষয় হলো বিএম- ২১ গ্রাড, যা ১২২ মিমি মাল্টিপল রকেট লাঞ্চার সিস্টেম, সোভিয়েত মডেলের ১৫২ মিমি এম-১৯৫৫ (ডি-২০) হাউইজার এবং ১২২ মিমি (ডি-৩০) হাউইজার গান ও তার গোলার সরবরাহ নিশ্চিত করা। অধিকন্তু, উত্তর কোরিয়ায় সোভিয়েত মডেলের ট্যাংকের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে, যেমন টি-৫৪ এবং টি-৬২, যা রাশিয়া কতৃক ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহৃত ট্যাঙ্ক সদৃশ এবং এগুলোর খুচরা যন্ত্রাংশের সরবরাহও নিশ্চিত করতে পারবে। প্রাক্তন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন উল্লেখ করেছেন যে উত্তর কোরিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে সোভিয়েত পতনের পর এটি রাশিয়ার সাথে প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
উত্তর কোরিয়া এবং রাশিয়ার মধ্যে বর্তমানে অর্থনৈতিক সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। উত্তর কোরিয়া তার ভূখণ্ড ব্যবহার করে দক্ষিণ কোরিয়ায় গ্যাস পাইপ লাইন ও বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণের জন্য রাশিয়ার একটি প্রস্তাব বিশেষ বিবেচনায় রেখেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় রাশিয়ার সরবরাহকৃত কয়লা পাঠানোর জন্য উত্তর কোরিয়ার কার্গো টার্মিনাল ব্যবহার করে একটি পাইলট প্রকল্প ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। মস্কো তার ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ কে ট্রান্স-কোরিয়ান রেলপথের সাথে সংযুক্ত করতে চায় যা রাশিয়া এবং কোরিয়ান উপদ্বীপকে একই রেলের নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসবে। ইতিমধ্যে, উত্তর কোরিয়া ইউক্রেনের রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চলের অবকাঠামো পুনঃনির্মাণে তাদের নির্মাণ শ্রমিক পাঠাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। রাশিয়া উত্তর কোরিয়ায় তার বাণিজ্যের ক্ষেত্রে জ্বালানি, পরিবহন, ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বিস্তৃত করতে চায়, যা জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
কিমের এই রাশিয়া সফর নিছক বাস্তব ফলাফলের চেয়ে কৌশলগত এবং প্রতিকী তাৎপর্য অনেক বেশি। এই শীর্ষ সম্মেলন আন্তর্জাতিক চাপ ও নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে কিমের কূটনৈতিক সফলতা ও দক্ষতার পরিচয় প্রকাশ করেছে। পুতিনের জন্য, এটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিষয়ে তার ভূমিকা এবং প্রভাবকে আরো শক্তিশালী করেছে, বিশেষ করে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাথে রাশিয়ার ইউক্রেন, সিরিয়া, ভেনিজুয়েলা, ও পশ্চিম আফ্রিকার মতো বিষয় গুলো নিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীন এই ক্রমবর্ধমান জোটের উপর সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে এবং এই সমীকরণের পিছনের একজন তাৎপর্যপূর্ণ উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড়। কিমের এই সফর চীনকে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে সাহায্য করেছে যখন পুতিনকে সমর্থনের বিষয়টি সামনে আসে। তাছাড়া তাইওয়ানের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র মনোযোগ সরিয়ে নিতেও এই শীর্ষ সম্মেলন সাহায্য করেছে। এই পশ্চিমা বিরোধী জোটের গতিশীলতা প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জন্য নিজদেশে, ইউরোপ এবং এশিয়ার হুমকি মোকাবেলায় জটিলতর করে তুলবে।
কিম-পুতিনের এই শীর্ষ সম্মেলনটি কেবল কোরিয়ান উপদ্বীপেই নয় বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের জন্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা। শীর্ষ পর্যায়ের এই বৈঠকটি উত্তর কোরিয়া-রাশিয়ার সম্পর্কের সম্ভাব্য সাফল্য এবং সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য তাদের প্রভাব তুলে ধরেছে।এই সম্মেলনটি ন্যাটো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা দেয় যে, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাকে দূরে ঠেলে পুতিন-কিম তার ঐতিহ্যবাহী মিত্র হিসাবে জোটবদ্ধ হওয়া মূলত ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যফ্রন্টে অংশগ্রহণের ইঙ্গিত দেয়।
—– লেখক: একজন কলামিস্ট —–