সমসাময়িক নাগরিক, বৈশ্বিক ও গ্রামীণ নৈসর্গিক পরিবেশ সচেতন কবি আর. কে. শাব্বীর আহমদ-এর ২য় কাব্যগ্রন্থ ‘চেতনার দুয়া ‘। এটি প্রকাশিত হয় অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ সালে। প্রকাশক : সরলরেখা প্রকাশনী সংস্থা। বইটির দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ।
সমসাময়িক নাগরিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি গ্রামীণ নৈসর্গিক পরিবেশ ও আটপৌরে জীবনের নিখুঁত ছবি এঁকেছেন কবি তাঁর এ গ্রন্থে। মুক্তক গদ্যছন্দ, স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দে তিনি কবিগুলোকে সাজয়েছেন। তাঁর লেখায় সদা সত্য সুন্দর ও মানবিক প্রেমের দর্শন লক্ষ্য করা যায়।
পার্থিব জীবনের মোহ, মায়া ও ভ্রান্তির বেড়াজাল ভেদ করে তিনি অনন্তকালে সুখের ঠিকানা গড়ার স্বপ্ন এঁকেছেন তাঁর কাব্যচিন্তায়। গ্রন্থের নাম কবিতা ‘ চেতনার দুয়ার ‘ এ তিনি লিখেছেন, ” জীবনের কতগুলো বসন্ত / পার হয়ে গেছে / ম্লান হয়ে গেছে কতে শতো কাক ডাকা ভোর / সব পাখি নীড়ে ফেরে / সব নদী ফিরে যায় মোহনায় / তবুও কী মন আমার / ভ্রান্তির বেড়াজাল ভেদ করে / ফিরে আসতে চায় না/ অনাদি অনন্তকালের জীবন পথে। “
বিশ্বজুড়ে নির্যাতিত মানবতার কান্নায় কবির হৃদয় সিক্ত হয়েছে। মানবতা ও মানবিক পৃথিবীর প্রত্যাশায় কবির উচ্চারণ, “আমি প্রতিনিয়ত / মানবতার কান্না শুনি / হৃদয়ে জ্বলে ওঠে আগুন / যেমনি ঘর্ষণে ঘর্ষণে জ্বলে ওঠে দেশলাই / সিরিয়া ফিলিস্তিন কাশ্মীর বার্মায় / আর্তনাদ ওঠে বনি আদমের / নিজ বাসভূমে বেঁচে থাকার আকুলতায় / যেমনি মায়ের বুকে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে সন্তানেরা।” ( মানবতার কান্না)
” বহমান সময় ” কবিতায় নিপীড়িত মানবতার জন্য কবির নিরাপদ ভূখণ্ডের আকুতি শুনি, ” লাখো-কোটি নিপীড়িত মানবতার / চীৎকার ধ্বনিত হয় পৃথিবীর অধিপতির কাছে / সাহায্যকারী বন্ধুর আগমন প্রত্যাশার / নিরাপদ ভূখণ্ডের / সোনালি সূর্যোদয়ের।”
নিরাপদ ভূখণ্ডে নবপ্রজন্মের হাসির মতো মুগ্ধতা চেয়েছেন কবি- ” নীলাকাশে রংধনুর মতো / মুগ্ধতা চাই / মুগ্ধতা চাই বিশুদ্ধ মানুষের / স্বচ্ছ সাদা মনের / যেমন হেমন্তের মেঘমুক্ত আকাশ / নিরাপদ ভূখণ্ডে নব প্রজন্মের হাসির / মুগ্ধতা চাই। ” ( মুগ্ধতা চাই )
নাগরিক জীবনের যন্ত্রণাকে আনন্দময় করে তোলার জন্য শেকড় সন্ধানী কবি মায়াবী প্রকৃতির গ্রামীণ জীবনের সারল্য ও অকৃত্রিম সুখের ছবি এঁকেছেন এভাবে, ” ঘুম ঘুম তন্দ্রালুতায় জেগে ওঠি / শরৎ প্রভাতে / শারদীয় বৃষ্টিকণায় মুছে নেই / নয়ন যুগল / সাদা-শুভ্র মেঘের ভেলায় / মন ভাসাই। ” ( শারদ নয়ন )। ” হেমন্ত আসে / সোনালি ধানের মৌ মৌ গন্ধে / সোনালি ধানের মৌ মৌ গন্ধে / নবান্নে হেসে ওঠে কৃষক / গোলাভরা ধানে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে / গৃহস্থ বধূরা। ” ( হেমন্তিকা )
সৌরভময় ফুলের নিঃস্বার্থ অমায়িক প্রেমের মতো মানবিক ও ভালোবাসার পৃথিবী গড়ে তুলতে চান কবি।
” ফুলের ভালোবাসা ” কবিতায় তাঁর উচ্চারণ : ” ফুলের ভালোবাসা / কী অমায়িক অমলিন / কী শুচিতা দেখি / ফুলের অঙ্গাবরণে / শিশিরস্নাত পরাগরেণু / নববধূর এলায়িত / কস্তুরি-কুসুম চুলের মতো / সুবাস ছড়ায় পরম মমতায় / ফুলের চোখে চোখ রেখে / নয়ন-যুগল স্নিগ্ধ করি / অবারিত প্রেম শিখি / ফুলিয়ে পেলব শরীর ছুঁয়ে / সার্থক হয় জনম জীবন / ফুলের মতো মানবিক প্রেমে। “
শিশুতোষ ছড়ায় কবি শিশুদের সুন্দর ও আদর্শিক অনুভূতি জাগ্রত করেছেন এভাবে : ” এক দুই তিন / মাগো আমার সালামটুকু নিন / চার পাঁচ ছয় / ন্যায়-নীতির পথে পথে পথে / হবে সবার জয়। ” ( সংখ্যার ছড়া )
ফুলের মতো সুবাস ছড়িয়ে ন্যায়-নীতির সমাজ গড়ে একটি নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছেন কবি : ” ফুলের মতো সুবাস তুমি ছড়াও / সত্য-ন্যায়ের সমাজ গড়ে বিশ্বটাকে নড়াও। ” ( বিশ্বটাকে নড়াও )।
” চেতনার দুয়ার ” গ্রন্থের কবিতাগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, প্রায় প্রতিটি কবিতায় কবি তাঁর কাব্যিক চেতনায় অসীম সত্তার অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্বকে প্রতীকায়িত করছেন। যেমন- ” হৃদয়ের সংবেদনশীলতায় / ন্যুব্জ হয় / আমার ভালোবাসার সারথীরা / অপরূপ স্রষ্টার সমীপে। ” ( ফুলের ভালোবাসা ) ” কী অপরূপতায় সাজালো পৃথিবী / অসীম যিনি মহাদয়াবান।” ( চন্দ্রালুতা ) ” অসীমের ভালোবাসা ঝরে পড়ুক / আকাশ-কোলের সৃষ্টিকুলে।” ( নিঃসীম নীলাকাশ ) ” আনত হৃদয়ে অবনত হয় আমার সত্তা / সর্বশক্তিমানের অপার মহিমায়।” ( বোধি )
কাব্যের শেষ দিকে কবির মৃত্যুচেতনা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর সুকৃতি মহানের দরবারে কবুল হয়েছে কি-না, এমন বিচলিত ভাবনায় কবির আকুতি : আমার সুকৃতি মহানের সমীপে / গৃহীত কি-না সে ভাবনা আমায় / কেবলি বিচলিত করে। “
” চেতনার দুয়ার ” কাব্যগ্রন্থটি সত্য-সুন্দর, মানবিক পৃথিবী গড়ার স্বপ্নচারিতায় বাঙলা কাব্যসাহিত্যে একটি সৃজনশীল সংযোজন হিসেবে বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পাবে বলে আমার বিশ্বাস।