জনতুষ্টিবাদী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিভক্তি একটি কৌশলমাত্র। গণতন্ত্রকে উপলক্ষ করে ক্ষমতায় আরোহনের লক্ষে এই বিভক্তি একটি কার্যকর হাতিয়ার। বিভাজিত জনতাকে যেমন যত সহজে প্রলুব্ধ করা যায়, ঐক্যবদ্ধ জনগণের শক্তিকে মোকাবেলা তেমনই কঠিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীকে আটকানোর যেসব কায়দা-কানুন বর্ণিত হচ্ছে, পুরুষগণ নিজেরাও সেসকল কৌশলে আটকা আছেন কিনা, কখনো ভেবেছেন কি?
সবার উপরে মানুষ সত্য। এই সত্যটাকে ধামাচাপা দেয়ার সহজ ও সরল পন্থা হচ্ছে মানুষকে ভাগ করে দাও। লিঙ্গ, ধর্ম, জাতি, বর্ণ, ধনী, গরীব, শোষক, শোষিত — বিভাজনের কৌশল অনেক। ঐক্যের জন্য আছে শুধুই একটি — ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’।
প্রাকৃতিক কারণেই নারী মা, নারী বোন, আবার স্ত্রী। বিষয়গুলো নিতান্তই প্রাকৃতিক। কৃত্রিমতা হচ্ছে ‘নারী যেভাবে আটকায়’। সংসারধর্মে নারী একাকী আটকে আছে, এর চাইতেও আরো সত্য হচ্ছে পূরুষও সেখানে কম আটকে নেই। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নারী ও পুরূষ উভয়েই আটকে আছে একটি কঠিন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়। পুরুষ যদি হয় রুজির কারিগর, নারীকে হতে হয় রুটির কারিগর। মুক্ত কেউই নন।
আসুন, টেকসই উন্নয়নের কথা বলি। এ উন্নয়ন আপনার বর্তমান চাহিদাকে (জৈবিকও বটে) পূরণ করবে, সেই সাথে আপনার ভবিষ্যত প্রজন্মকেও নিরাপদ রাখবে। আমাদের এ দায়িত্বহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যত সংসারকেই রক্ষা করতে হবে। সংসার হবে দুজন সম্মিলিত নারী ও পুরুষের টেকসই উন্নয়নের আধার। এদের কেউ কর্মজীবি, কেউ বা সংসারকর্মী। কষ্টের কথা হচ্ছে, রাস্ট্রতো অন্তত: নারীর সাংসারিক কর্মকে অর্থনৈতিক মানদন্ডে ফেলে জিডিপিতে যোগ করে নিতে পারত! তাতে অন্তত: নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি না হোক ক্ষমতাসীনদের জিডিপির গাঁজাখুরি গল্পটা আরো শানিত হতো!
আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে নারীর ক্ষমতায়নের তেত্রিশ বছর হলো। নব্বই থেকে ২০২৩। খালেদা থেকে হাসিনা। শেষ পণেরটি বছর তো ক্ষমতা একবারেই নারীময়। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। সুনীলের ভাষায় নারী বুকে এখনো শুধূই মাংসের গন্ধ। জনগণের ক্ষমতায়ণই যেখানে হারিয়ে গেছে, নারীর ক্ষমতায়ন তো নস্যি। নারী কি জনগণের বাহিরের কোন স্বত্ত্বা?
বরং নারীর মাতৃস্বত্তাকে ব্যবহার করে অবিরাম চলেছে পুঁজির যথেচ্ছ ব্যবহার, লুটপাট। শাসন ও শোষনের যাতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে নারী ও পুরুষ উভয়েই। ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে গণতন্ত্র, মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। দূর্ভিক্ষের জায়নামাজে নারী-পুরূষ আজ একই কাতারে।
বলা যায়, দূর্বল রাজনৈতিক সংস্কৃতির ফাঁদে ফেলে নারীকে ব্যবহার করেছে একটি দূর্বৃত্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা। গণতন্ত্রহীণ এ সমাজে রাষ্ট্র আজ নিজেই পড়েছে ফাঁদে, জাতিকে ফেলেছে ফের হায়েনার কবলে। একাত্তরের বাইশ পরিবারের গল্প শুনেছি। ২০২৩-এর মাঝামাঝিতে এ পর্যন্ত ১১ পরিবারের কথা জানান দিচ্ছে মিডিয়া। এই সকল পরিবারগুলো কি প্রকৃতই নারীমুক্ত? এস আলমের অর্থ পাচারের দায় কি মিসেস আলম এড়াতে পারবেন?
২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন হোটেল শেরাটন শাখা থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে হলমার্ক গ্রুপ। এর মধ্যে ফান্ডেড প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। আর নন-ফান্ডেড ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ফান্ডেড অংশের অনুসন্ধান শেষে ২০১২ সালে ১১টি মামলা করে দুদক। ২০১৩ সালে বেশকিছু মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়। এসব মামলায় হলমার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন বেশকিছু কর্মকর্তাকে সাজা দিয়েছেন আদালত।
এছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত একটি, বেসরকারি দুটিসহ তিনটি ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছে আলোচিত বিসমিল্লাহ গ্রুপ। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী, তার স্ত্রী গ্রুপের চেয়ারম্যান নওরীন হাসিব এখন বিদেশ পলাতক। তারা ঋণের বেশির ভাগ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। দুদক এই দম্পতিসহ ৫৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দায় শেষ করেছে।
আজকে তাই বিভিন্নভাবে বিভক্তিকে জিইয়ে রেখে ক্ষমতাসীনচক্র ক্ষমতায় থেকে যেতে চায়। আবার ক্ষমতাহীন গোষ্ঠী বিভক্তির মাধ্যমেই ক্ষমতা ফিরে পেতে চায়। নারী-পুরুষ কেউই সেখানে মুখ্য নয়। একাত্তরের পর এ যাবৎকালে এত বড় ক্রান্তিকালে দেশ আর কখনোই পড়েনি। নব্বই এর গণ আন্দোলন যেখানে ছিলো শুধুমাত্র গণতন্ত্রের লড়াই। ২০২৩ এ এসে এর সাথে যুক্ত হয়েছে সার্বভৌমত্ব (প্রকাশ্যে-গোপনে বিদেশী নানা শক্তির তৎপরতা), অর্থনৈতিক মুক্তি (ব্যাপক বৈষম্য) ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থা (ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাহীন, হেফাজত-জামায়াত আজ একাকার) প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই। একাত্তরে যা কিছু অর্জন করেছিলাম, গত ৫২ বছরে ক্ষমতার রাজনীতি করতে গিয়ে এর সবকিছুকে্ই জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে।
আবারো যেন শুন্য থেকেই শুরু করতে হবে।
(লখক মানবাধিকার শিক্ষা বিষয়ক গবেষক)।