মিয়ানমার সরকারের জাতিগত নিপীড়ন ও নির্যাতনের মুখে সে দেশের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছিল তিন বছর আগে এই দিনে। এরপর দফায় দফায় আলোচনা এবং দুই দেশ দুই দফা তারিখ দিয়েও কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো যায়নি। ইতিপূর্বে চীন মধ্যস্থতা শুরু করলেও তাতে কোনো ফল আসেনি। এ বিষয়ে আলোচনা করার ব্যাপারে সম্প্রতি ভারত আগ্রহ দেখিয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের সময় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দিল্লির অবস্থানের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওই সময় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারতের ভূমিকা রাখার প্রসঙ্গটি তুলেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে ভারত। ওই প্রেক্ষাপটে নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ভারত প্রতিবেশী দুই দেশ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ১৮ আগস্ট দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। পরদিন ঢাকা ছাড়ার আগে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ করেন। কোন আলোচনায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারত দুই দেশের সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ দেখিয়েছি, কূটনৈতিক সূত্রগুলো বিস্তারিত জানায়নি।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর চরম নির্যাতনের মুখে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে আসা শুরু করে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ ৪০ হাজার। পুরোনো ও নতুন মিলিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার চুক্তি করলেও বাস্তবে কোনো অগ্রগতি হয়নি। গতকাল সোমবার ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনায় পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, ‘রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরির ব্যাপারে মিয়ানমার ন্যূনতম রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বরং আমাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ব্যাপারে তাদের মধ্যে অনীহা দেখতে পেয়েছি।’
রোহিঙ্গা সমস্যার শুরু থেকেই নানান গড়িমসি করে যাচ্ছে মিয়ানমার। পরিবেশ তৈরি না করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুতি ও তালিকা পাঠানোর জন্য তোড়জোড় শুরু করে। এরপর তালিকা যাচাই–বাছাইয়ে দেরি করা ও নানা ধরনের গড়িমসির মধ্য দিয়ে তিন বছর পার করেছে দেশটি।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের তালিকা নিয়ে মিয়ানমার সম্প্রতি এক নতুন কৌশল নিয়েছে। মার্চ মাসের শুরুতে দেশটির কাছে ৪ লাখ ৯২ হাজার ৩০২ জন রোহিঙ্গার তালিকা পাঠায় বাংলাদেশ। ঢাকায় মিয়ানমারের দূতাবাস ওই তালিকা উড়োজাহাজে করে ইয়াঙ্গুন পাঠিয়েছিল। হঠাৎ এ মাসের মাঝামাঝি ঢাকায় মিয়ানমার দূতাবাস জানায়, থাইল্যান্ড থেকে ওই তালিকা খোয়া গেছে। কাজেই নতুন করে তালিকা দিতে হবে। গত সপ্তাহে ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আবার মিয়ানমারকে খোয়া যাওয়া ওই তালিকাই পাঠানো হয়েছে।
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, সর্বশেষ দেওয়া ওই তালিকাসহ ছয় দফায় মিয়ানমারকে ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩২৩ জন রোহিঙ্গার তালিকা পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার এখন পর্যন্ত দুই দফায় তালিকা পাঠিয়ে মাত্র ১০ হাজার ৩৪ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ ফেলো মো. শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তথ্য অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়া এখনো নিরাপদ নয়। সে জন্য নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করাটা জরুরি। রাখাইনে মানবাধিকারের সুরক্ষা ও রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যতের স্বার্থে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে আসার বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বোঝা উচিত, আদি নিবাসে ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের সারা জীবন অপেক্ষা করতে হবে, এমন বিকল্প কারও জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।
কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, ছোট আকারে হলেও এ বছরের প্রত্যাবাসন শুরু করা উচিত। এ জন্য সেখানে নিরাপত্তা ও সব ধরনের মৌলিক সুবিধা নিশ্চিত এবং নাগরিকত্বের পথনকশা ঠিক করতে হবে। কিন্তু মৌলিক এই তিন বিষয়ে কোনো কাজই হয়নি। তাই ছোট একটি দলকে পাঠানো গেলে তারা দেখতে পেত রাখাইনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য কতটা সহায়ক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে হবে। অনেকের ধারণা, সমস্যাটা দ্বিপক্ষীয়। আসলে এটা বৈশ্বিক সমস্যা। মিয়ানমার যখন বুঝবে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে, তখন সে বুঝবে তাকে সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু উদ্যোগ নিতেই হবে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে জাপান ও ভারতের মনোভাবের ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এখন ভারত ও জাপান যদি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে চীন বুঝতে পারবে মিয়ানমারের সঙ্গে সে ছাড়া কেউ নেই। আর এটি করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপটা বাড়াতেই হবে।