ভাস্কর্য অপসারণ নাকি নেপথ্যে অন্য কিছু?
গত কয়েকদিন যাবৎ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মপ্রিয় মানুষের মনে বিদ্বেষ ছড়ানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা ভাস্কর্যকে মুর্তির সাথে তুলনা করে একে ইসলাম বিরোধী আখ্যা দিয়ে তা অপসারণের ঘোষণা দিয়েছে। হেফাজতের আমির সর্বজন শ্রদ্ধেয় আল্লামা সফি সাহেবের মৃত্যুর পর নতুন কমিটি গঠিত হবার সাথে সাথেই কতিপয় নেতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের দাবিতে অত্যন্ত আক্রমণাত্বক বক্তব্য প্রদান করে সরাসরি রাষ্ট্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। যদিও নতুন কমিটি নিয়ে তাদের দলের মধ্যেই বিতর্ক রয়েছে। আল্লামা সফি সাহেবের ছেলে সহ তাঁর অনুসারীদের এই কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদপড়াদের অভিযোগ হেফাজতের গঠনতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্টদের নেতৃত্বে না রাখার বিধান থাকলেও নবগঠিত কমিটিতে জামাতে ইসলামি ও বিএনপি জোটের বিভিন্ন ইসলামিক দলের শীর্ষ নেতাদের স্হান দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়ারাও পাল্টা কমিটি গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে প্রত্রিকার খবরে প্রকাশ।
উল্লেখ্য উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন হেফাজতে ইসলামি মুলত কওমি মাদরাসা ভিত্তিক একটি ধর্মীয় সংগঠন। প্রথমে তারা নিজেদেরকে অরাজনৈতিক দল বলে দাবি করলেও এখন এই সংগঠনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের বিভিন্ন পদপদবিতে বসানো হয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেক শীর্ষ নেতা এ সংগঠনে শীর্ষ পদে আসীন রয়েছে । কওমি মাদরাসা সম্পুর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। জনসাধারণের কাছ থেকে দান, অনুদান, ছদকা,যাকাতের টাকা নিয়ে এসব মাদরাসা পরিচালিত হয়ে থাকে। আগে এসব মাদরাসা সনদের কোন সরকারি স্বীকৃতি ছিল না। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারই এসব মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি দিয়েছে। করোনার মহামারির মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশের সকল কওমি মাদরাসার শিক্ষক, মসজিদের ঈমাম,খতিব ও মোয়াজ্জিনদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এ রকম সরকারি অনুদান প্রদানের ঘটনা অতীতে কোন সরকারের সময় দেখা যায়নি।
অনেকেরই মনেই প্রশ্ন হঠাৎ করে হেফাজতে ইসলামী ভাস্কর্য ইস্যুতে মাঠে নামার কারণ কি? অথচ সকলেরই জানা এদেশে ইসলামের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক ইসলামি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা,মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড গঠন,কাকরাইলে তাবলীগ জামাতের মসজিদ ও টঙ্গীতে বিশ্ব এস্তেমার জন্য জমি বরাদ্দ,মদ জুয়া বন্ধ এবং বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক আরবি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা,কওমি মাদরাসা সনদের সরকারি স্বীকৃতি,প্রতিটি উপজেলায় দৃষ্টিনন্দন মডেল মসজিদ নির্মাণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারপরও কেন এই সরকারের বিরুদ্ধে হেফাজতের এই যুদ্ধান্দেহী অবস্থান এই প্রশ্ন আজ অনেকের। তাহলে কি ভাষ্কর্য ইস্যুর নেপথ্যে অন্য কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিহীত রয়েছে? হেফাজত নিজেদেরকে অরাজনৈতিক দাবি করলেও তাদের সদ্য ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে জামাত-শিবিরের শীর্ষ স্হানীয় কয়েকজন নেতা সহ বিভিন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নির্বাচনী প্রতিক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারি বেশ কয়েকজন নেতার নামও রয়েছে। তাহল কি এসব নেতাদের ইন্দনে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবেই ভাস্কর্যকে ইস্যু হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে?
হেফাজতের নেতারা ভাস্কর্যকে মুর্তির সাথে তুলনার মাধ্যমে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার ষড়যন্ত্র করছে বলেই তাদের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে। কারণ মুর্তি হলো উপাসনার বস্তু আর ভাস্কর্য একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচারের নিদর্শন । মুর্তির কাছে গিয়ে কোন কোন ধর্মের মানুষ উপাসনা করে। কিন্তু ভাস্কর্যের কাছে কেউ উপাসনা করতে যায় না। ভাস্কর্যের মাধ্যমে শিল্প, সংস্কৃতিতে পুরো বিশ্বের কাছে মুসলিমদের গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আধুনিক কৃষ্টি-কালচার তুলে ধরা যায়।
গত শনিবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্তী জনাব ওবায়দুল কাদের এমপি এক প্রেস ব্রিফিং উগ্র সাম্প্রদায়িক ইসলামি সংগঠনটির হুমকির জবাব দিতে গিয়ে তিনি ভাস্কর্য ও মুর্তির পার্থক্য তুলে ধরে পবিত্র কোরআনের দুইটি আয়াত উদ্ধৃত করে বলেছেন, “পবিত্র কোরআনের সূরা সাবার ১৩ নং আয়াতে বর্ণিত ‘তামাসিলা’ এবং সূরা ইব্রাহিমের ৩৫ নং আয়াতে বর্ণিত ‘আসনাম’ শব্দ ২ টি এক নয়। কাজেই মুফাসসিরগণ মনে করেন তামাসিলা মানে ‘ভাস্কর্য’আর আসনাম মানে ‘প্রতিমা- পূজা’। এ’দুটি শব্দকে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ভুলব্যাখ্যা করা হয়েছে”। তিনি অপব্যখ্যাকারিদের প্রকৃত ইসলাম চর্চার আহবান জানিয়ে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে সবাই বিরত থাকা এবং ধর্মকে রাজনৈতিক ইস্যুতে ব্যবহার না করারও আহবান জানান
মুসলিম বিশ্বের বহু দেশে ভাস্কর্য বিদ্যমান রয়েছে। খোদ সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, মিসর, ইরান, ইরাক,কাতার এমনকি পাকিস্তান সহ অনেক মুসলিম অধ্যুষিত দেশে ভাস্কর্য রয়েছে।
খোদ সৌদি আরবে উট, ঘোড়া বা গাংচিলের প্রচুর ভাস্কর্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষিত করে । সৌদি আরবের রাজধানী জেদ্দায় মুষ্টিবদ্ধ হাত, হাঙরি হর্স, মানব চোখ, মরুর বুকে উটের বিশাল বিশাল ভাস্কর্য রয়েছে।
এ উপমহাদেশের অধিকাংশ খ্যাতনামা স্থাপত্যই মুসলমান শাসকদের অনন্য সৃষ্টি। ইরান, মিসর, মরক্কো, ইরাকের জাদুঘরে এবং উন্মুক্ত স্থানে অনেক দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য রয়েছে। কবি ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম, পারস্যের নেপোলিয়ন বলে খ্যাত নাদির শাহ মতো খ্যাতিমান ব্যক্তিদের ভাস্কর্য রয়েছে ইরানে। ইরানের রাজধানী তেহরানে দু’বছর পর পর অনুষ্ঠিত হয় সমকালীন ভাস্কর্য প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা। মুসলিম দেশ মিসরের কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে মাহমুদ মোখতারের বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘মিসরের রেনেসাঁ’। ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে ডানার ভাস্কর্যটি সবার নজর কাড়ে। দেশটির আল-মনসুর শহরে আছে মনসুরের একটি বিশাল ভাস্কর্য। অনেক সাধারণ সৈনিকের ভাস্কর্যও আছে।
ইন্দোনেশিয়া সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ। সেখানে প্রচুর ভাস্কর্য রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার পর্যটন এলাকা বালিতে স্থাপিত বিপুল সংখ্যক ভাস্কর্য সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। বিশ্বের অন্যতম মুসলিম দেশ মালয়েশিয়ায় ও প্রচুর ভাস্কর্য রয়েছে। দেশটির সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘ন্যাশনাল মনুমেন্ট’। পনের মিটারের বিশাল এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদ বীরদের স্মরণে। মালয়েশিয়ার অন্য উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হলো- বাতু কেভসের বিখ্যাত মুরুগান, কুচিং হলিডে ইন হোটেলের সামনে মার্জার মূর্তি এবং কনফুসিয়াসের মূর্তি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে নির্মিত ভাস্কর্যের মধ্যে বুর্জ আল খলিফার বিপরীতে সংস্থাপিত আরবীয় যুগলের মূর্তি, দুবাইয়ের ওয়াফি অঞ্চলের প্রবেশপথে পাহারাদারের প্রতিমূর্তি হিসেবে সংস্থাপিত কুকুরের মূর্তি, দুবাইয়ের ইবনে বতুতা মার্কেটে স্থাপিত মূর্তি উল্লেখযোগ্য। তুরস্ক ও কাতারের বিভিন্ন স্থানে দৃষ্টিনন্দন অনেক ভাস্কর্য রয়েছে।
এসব ধর্মান্ধরাই একসময় ফতোয়া দিয়েছিল ছবি উঠানো,মাইক ব্যবহার হারাম। এখন তারা শুধু ছবি উঠানোই নয় তাদের বক্তব্য প্রচার কারা জন্য নিজস্ব ক্যারাম্যান নিয়োগ দিয়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়া এবং ফেইসবুক,টুইটার সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছেন। শুধু মাইক ব্যবহারই নয় মাইকের আওয়াজ শ্রুতিমধুর করার জন্য ট্রাক ভর্তি করে বড় বড় সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্হা করে সমাবেশ ও জলসার আয়োজন করেন। ।
ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করেন তাদের উদ্দেশ্যই হলো ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ধর্মীয় অনুভুতিকে পুঁজি করে মাঠ গরম করা। বাংলাদেশে এসব ধর্ম ব্যবসায়ীরাই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকে নাজায়েজ ফতোয়া দিয়েছিল। তারা সেদিন ইসলাম রক্ষার নামে রাজাকার,আলবদর,আলসামস বাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। তাদের প্ররোচনায় অনেক সাধারণ মানুষও সেদিন মুক্তযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এসব ধর্মব্যবসায়িরা একাত্তরে আমাদের মা বোনদের পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে তুলে দিয়েছিল। হানাদারদের ভোগের পন্য বানিয়েছিল। তারা এখনো এদেশে ঘাপটি মেরে আছে। সুযোগ পেলেই তারা ফনা তুলে। তারা লেবাস বদল করে সর্বত্র ঢুকে পড়েছে । তাদের কেউ কেউ আবার সরকারি পৃষ্টপোষকতা ও পাচ্ছে। তারা বিভিন্ন কায়দায় সরকারি দলেও ঢুকে পড়েছে। তাদেরকে চিহ্নিত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর এখনই উপযুক্ত সময়। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে এ বর্বরতা আর মেনে নেওয়া যায় না। মেনে নেওয়া উচিত নয়।
লেখক:স্বৈরাচার ও সাম্প্রতিকতা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারানির্যাতিত সাবেক ছাত্রনেতা,সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ (স্বাশিপ),কেন্দ্রীয় কমিটি। ইমেইল salamshaju@gmail.com