ঢাকায় গাবতলীর তুরাগ নদের সীমানা চিহ্নিত পিলারের ভেতর শতাধিক প্লট বরাদ্দ নবায়ন করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ।
নদীর সীমানায় বহু বছর ধরে জবরদখলদারদের ইট, বালু, খোয়া ও পাথরের ব্যবসার সুযোগ দিতেই এটা করা হয়। ফলে উচ্ছেদের মধ্যেও তারা টিকে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলোর সঠিক সীমানা চিহ্নিত করতে এবার দুর্বারগতিতে দখলদার উচ্ছেদ করছে বিআইডব্লিউটিএ।
যে অভিযানে নিস্তার মেলেনি এমপি, সরকারি অফিস এবং সরকারদলীয়দের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। এ অবস্থার মধ্যে তুরাগের সীমানা পিলারের ভেতরেই ২০১৩ সালে বরাদ্দকৃত শতাধিক প্লটের নবায়ন করেছে বিআইডব্লিউটিএ।
অভিযোগ উঠেছে, মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব প্লটের নবায়ন করেছেন। এসব কারণে উচ্ছেদ কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তুরাগের সীমানা পিলারের ভেতরের প্লট নবায়ন করায় বিআইডব্লিউটিএর উচ্ছেদ কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এতে ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর দখলদার উচ্ছেদ কার্যক্রম ভেস্তে যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হলে বরাদ্দ বাতিল করে নদের আদলে ফিরিয়ে নিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বিআইডব্লিউটিএকে।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাছের খান যুগান্তরকে বলেন, ‘নদীর সীমানা পিলারের ভেতর জায়গা বরাদ্দ দেয়া বেআইনি। এতে উচ্চ আদালতের অবমাননা হচ্ছে। কেননা, নদীর সীমানার ভেতর এ ধরনের কার্যক্রম না করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএর উচিত হবে আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার প্রতি সম্মান দেখিয়ে নদের সীমানার ভেতর বরাদ্দকৃত প্লটগুলো বাতিল করে নদের জায়গা নদে ফিরিয়ে দেয়া।
একই বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, ‘নদের সীমানা পিলারের ভেতর ব্যবসার জন্য জায়গা বরাদ্দের কোনো সুযোগ নেই। বিআইডব্লিউটিএ কোনো ব্যক্তিস্বার্থে যদি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তাদের সেখান থেকে সরে আসতে হবে।’
সরেজমিন দেখা গেছে, গাবতলী-বাবুবাজার বেড়িবাঁধ সড়কের গাবতলী পশুর হাট থেকে কৃষি বিপণন অধিদফতরের মার্কেট পর্যন্ত তুরাগের সীমানা পিলারের ভেতর শতাধিক স্থানে ইট, বালু, খোয়া ও পাথরের রমরমা ব্যবসা চলছে।
এসব প্লটে কেউ বালুর আড়ত করেছেন। কেউবা ইট, পাথর এবং খোয়ার আড়ত করেছেন। এসব আড়তের শ্রমিক এবং ইট, পাথর ও বালুর ক্রেতাদের সেবা দেয়ার জন্য সেখানে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু হোটেল এবং চায়ের দোকান।
বিআইডব্লিউটিএর সীমানা চিহ্নিতকরণ ভুলের কারণে বর্তমান সীমানা পিলার থেকে অনেক ভেতরে তৈরি করা হয়েছে নদের পাড়ের হাঁটাচলার পথ। ইট, পাথরের তৈরি এ ওয়াকওয়ের পরেও তুরাগ নদের জায়গা রয়েছে।
বর্তমান সীমানা পিলারে সেটা পরিষ্কারভাবে দেখানো হয়েছে। নতুন সীমানা পিলার স্থাপনের পরই পরিষ্কার হয়েছে, তুরাগ নদের ভেতরই গড়ে উঠেছে শতাধিক ইট, খোয়া, বালু এবং পাথরের ব্যবসা।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের গাবতলীর তুরাগ নদের পাড়সংলগ্ন মার্কেট থেকে গাবতলী গরুর হাটের সীমানা পর্যন্ত ওয়াকওয়ে ধরে হেঁটে মানুষের কর্মব্যস্ততা লক্ষ্য করা গেছে।
একইভাবে তুরাগের নতুন সীমানা পিলার ধরে হেঁটে ছোট ছোট ঘর তুলে ইট, বালু, পাথর ব্যসায়ীদের বসে থাকতে দেখা গেছে। এসব ঘরের পাশে কারও ১০ শতাংশ, কারও ৫ শতাংশ প্লটে নির্মাণসামগ্রী রাখতে দেখা গেছে।
শ্রমিকরা জাহাজ থেকে মাথায় করে এসব প্লটে ইট, খোয়া, বালু এবং পাথর নামিয়ে রাখছেন। অন্যদিকে ট্রাকে করে নির্মাণসামগ্রী নিয়ে যেতেও দেখা গেছে।
দিনে এমন চিত্র তেমন চোখে পড়ে না। সন্ধ্যার পর থেকে এখানে ব্যবসা জমে উঠে। ব্যবসায়ীরা রাতভর সেখানে কেনাবেচা করেন।
জানতে চাইলে গাবতলী ইট, পাথর এবং বালুর আড়ত ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মাহমুদুল হাসান মনির যুগান্তরকে বলেন, আমরা যারা দীর্ঘদিন থেকে এখানে ব্যবসা করছি, তাদের প্লট বরাদ্দ দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
সরকারি নিয়ম অনুসরণ করে বিআইডব্লিউটিএকে ট্যাক্স পরিশোধ করছি।’ তিনি বলেন, ‘আমার ১১ শতাংশের একটি প্লট রয়েছে। ভ্যাট, ট্যাক্স বাদে প্রতি বছর ৩৩ হাজার টাকা বিআইডব্লিউটিএকে পরিশোধ করছি।
সীমানা পিলারের ভেতরের আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বহু বছর আগ থেকে তুরাগের ঘাটসংলগ্ন তীরে অবৈধভাবে ব্যবসায়ীরা ইট, বালু, পাথর ও খোয়ার ব্যবসা করে আসছেন। বেড়িবাঁধ থেকে নদের তীর পর্যন্ত দখলদাররা জেঁকে বসেছেন।
এ প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্মপরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) একেএম আরিফ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘অনেক আগে বিআইডব্লিউটিএ ওই জায়গা প্লট করে বরাদ্দ দিয়েছে। ব্যবসা কার্যক্রমকে সহায়তা করতে এসব প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবারও সেটা নবায়ন করা হয়েছে।’
একই বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) কাজী ওয়াকিল নওয়াজ যুগান্তরকে বলেন, ‘তুরাগ নদের সীমানা পিলারের ভেতর যদি কোনো ব্যবসায়ীকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে এবং এটা যদি নদ উদ্ধার কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তবে তা বাতিলের ব্যাপারে কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’
সুত্র: যুগান্তর।