কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ–শঙ্কা আছে। এই প্রযুক্তি নিজে নিজেই বাংলা শেখার পর এই শঙ্কা আরও বেড়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রযুক্তি নিয়ে ভীতি ছড়ানো অযৌক্তিক।
কোনো প্রশিক্ষণ দিতে হয়নি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিজে নিজেই বাংলা ভাষা শিখেছে। কীভাবে এটা সম্ভব। বিষয়টি নিয়ে শুরু হয়েছে শোরগোল। মানুষের মনে তৈরি হয়েছে ভীতি। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তাহলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অগোচরে কত দূর যেতে পারবে?
গবেষকদের ধারণা, নিজের প্রয়োজনে নিজেই ইন্টারনেটের তথ্যভান্ডার কাজে লাগিয়ে বাংলা ভাষা শিখে নিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কারণ, ইন্টারনেটে এখন বাংলা ভাষা অনেক সমৃদ্ধ। তবে একটা কথা থেকে যাচ্ছে, তাকে কোনো প্রশিক্ষণ বা কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তাহলে কীভাবে সে বাংলা শিখল। এটাই তৈরি করেছে আতঙ্ক। কারণ, ইন্টারনেটে নানা ভুয়া তথ্য থাকে। তা থেকে বাছাই করে কতটা সঠিক তথ্য পরিবেশন করতে পারবে এআই—সে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। তা ছাড়া এই প্রযুক্তি তো এখনো গবেষকেরা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি। সব মিলিয়ে একধরনের উদ্বেগ–আতঙ্ক আছে।
মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের তৈরি চ্যাটজিপিটি ও গুগলের বার্ড চ্যাটবট ঘিরে মানুষের আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে বিভ্রান্তিও। মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের মতো প্রযুক্তি উদ্যোক্তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নের পক্ষে কথা বলছেন। অন্যদিকে টুইটারের প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্কের মতো প্রযুক্তি উদ্যোক্তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত উন্নয়ন রুখতে চান। গত মাসে ফিউচার অব লাইফ ইনস্টিটিউট নামের একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) এক খোলা চিঠিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত উন্নয়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে ইলন মাস্কের মতো বিশ্বের বড় বড় প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, গবেষক ও বিজ্ঞানীরা স্বাক্ষর করেছেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আতঙ্কের আরেকটি বড় কারণ, এটি মানুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেস্টিভ্যাল অব ডেঞ্জারাস আইডিয়াস অনুষ্ঠানে অধ্যাপক টবি ওয়ালস পূর্বাভাস দেন, ২০৬২ সাল নাগাদ মানুষের বুদ্ধিমত্তার সমকক্ষ হয়ে উঠবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ওই সময় নাগাদ এই প্রযুক্তি সৃজনশীলতা ও মানসিক বুদ্ধিমত্তার বৈশিষ্ট্যে মানুষের সমকক্ষ হবে; কিন্তু মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছাপিয়ে গেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে আচরণ করবে, তা এখনো অজানা।
তবে কানাডার প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট ডিজিটাল জার্নালে লেখা এক উপসম্পাদকীয়তে সাংবাদিক পল ওয়ালিস লিখেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে নিজে থেকে বাংলা ভাষা শিখেছে, তাতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কতটা ভীতিকর
প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য বাইটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষের মতোই গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমন জিনিস শিখছে বা জেনে নিচ্ছে, যা তার জানা উচিত নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই জানাশোনার বিষয়টি মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে।
দ্য বাইটের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সম্প্রতি মার্কিন গণমাধ্যমে সিবিএসের ‘৬০ মিনিটস’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গুগলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জেমস মানিকা বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের এআই সিস্টেমগুলোর একটি নিজেই বাংলা শিখেছে। এই সিস্টেমে বাংলা ভাষার প্রোগ্রামিংও করা হয়নি; কিন্তু বেশ দক্ষভাবে সিস্টেমটি সহজেই সব বাংলা অনুবাদ করতে পারে।
গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে বাংলা ভাষা শিখেছে, তাকে বলা যায় ‘ইমার্জেন্ট প্রোপার্টি’। এ বিষয়টি তুলে ধরে সিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, গুগলের এই ‘ইমার্জেন্ট প্রোপার্টি’র বিষয়টি রহস্যময়। ইমার্জেন্ট প্রোপার্টি মূলত পৃথক উপাদানের মিথস্ক্রিয়ায় উদ্ভূত নতুন ফাংশন বোঝায়। এ ধরনের ইমার্জেন্ট প্রোপার্টি এখন পরিচিত হয়ে উঠলেও অনেক সময় ডেভেলপারকে ধাঁধায় ফেলে দেয়।
বাংলা ভাষা শেখা ও ব্ল্যাকবক্স
গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুন্দর পিচাইও স্বীকার করেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বাংলা শেখানো হয়নি। সে নিজেই শিখে নিয়েছে বাংলা। সিবিএসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তাঁদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অদ্ভুত কিছু ঘটেছে। এমনকি বিশেষজ্ঞরাও এর ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘এই প্রযুক্তির একটি দিক আছে, যা আমরা বুঝতে পারি না। এ ক্ষেত্রে আমরা সবাই এটিকে ব্ল্যাকবক্স বলে ডাকি।’
পিচাই আরও বলেন, ‘আপনি পুরোপুরি বুঝতে পারবেন না, এটি কেন, কী বলছে। আপনি তা ঠিকমতো ধরতে পারবেন না।’
সাক্ষাৎকারে সিবিএসের সাংবাদিক স্কট পেলি জনসাধারণের জন্য এমন একটি সিস্টেম খোলার যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি প্রশ্ন করেন, যেখানে নির্মাতারাই বুঝতে পারছেন না যে তাঁরা কী তৈরি করেছেন, তাতে অন্যদের ক্ষেত্রে অবস্থাটা কী হবে। জবাবে পিচাই বলেন, ‘আমি মনে করি, মানুষের মন কীভাবে কাজ করে, তা-ও তো আমরা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি না।’
বিশেষজ্ঞদের যুক্তি
সাংবাদিক পল ওয়ালিস তাঁর উপসম্পাদকীয়তে লিখেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ প্রচারকারী একটি দল রয়েছে। তাঁরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতটিকে যতটা সম্ভব ভয়ংকর বলে প্রচার চালাচ্ছেন। মানুষের মধ্যে আনকোরা কোনো বিষয়ে ভীতি ছড়ালে তা কিন্তু প্রভাব ফেলে। এর মাধ্যমে নিজেদের লাভ তুলতে চান তাঁরা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাংলা ভাষা শিখছে, এটি নিয়েও তাই ভীতি ছড়ানো হয়েছে। তাঁর মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলা ভাষা শিখেছে, এটা কোনো রহস্য নয়।
সাংবাদিক ওয়ালিসের মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহ করতে ইন্টারনেটের তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে। এ ছাড়া বিশ্বে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যাও কম নয়। বাংলা ভাষায় প্রচুর প্রকাশনা ও অনেক বাংলা গণমাধ্যম রয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাংলা ভাষা কেন শিখবে না? সংজ্ঞা অনুসারে, এআইকে ব্যাখ্যা করার মতো সক্ষম হতে হবে। এটি তার কাজের অন্যতম অংশ। তাই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্তৃত কর্মপরিধির জন্য ভাষা শেখা অনেকটা অনিবার্য। এ কারণেই বাংলা ভাষাকে আয়ত্ত করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
ওয়ালিস তাঁর লেখায় বলেছেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝলক দেখে আপনি বিস্মিত হবেন। গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সিস্টেমে বাংলায় কাজ করার কর্মদক্ষতা খুব কম রয়েছে।’ ওয়ালিস প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এমন একটি ভাষায় কর্মদক্ষ করবেন, যে ভাষায় এটি কথা বলে না?’
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ওয়ালিস লিখেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আলোচনা নতুন স্তরে পৌঁছেছে। অনেকেই বলছেন, এটি পৃথিবী বদলে দেবে। তা হয়তো কিছুটা বদলে দিতে পারে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ভীতিকর করে তোলার বিষয়টি অযৌক্তিক বলেই মনে করেন তিনি।
-প্রথম আলো