প্রণব মুখার্জি আর নেই: সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা ভারত সরকারের। বুধবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার।
মস্তিষ্কে জমাট বাঁধা রক্ত, দোসর হয়েছিল করোনাভাইরাস। তারপর থেকেই ছিলেন গভীর কোমায়। কঠিন লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত সোমবার বিকালে ভারতীয় সময় ৫টা ২৫ মিনিটে হার মানলেন উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় এক বাঙালি রাজনীতিবিদ। চলে গেলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি দুই বাংলায় ‘প্রিয়জন’ প্রণব মুখার্জি।
সোমবার সন্ধ্যাবেলা দিল্লির সেনা হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার। এ সময় ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতির বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। ছেলে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় টুইট করে খবর দেয়ামাত্রই শোকাহত গোটা দেশ। নিস্তব্ধ তার জন্মভিটে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের কীর্ণাহার। শোকস্তব্ধ বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের বাঙালি সমাজ।
একাধারে তিনি ছিলেন নড়াইলের জামাই, অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান অনেক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি। নানা ইস্যুতে পাশে দাঁড়ানোয় বাংলাদেশের মানুষের কাছে ছিলেন তিনি বড়ই আপনজন। সেই নেতার প্রয়াণে বাংলাদেশের জনগণ অকৃত্রিম বন্ধু হারানোর শোকে মুহ্যমান।
সাবেক রাষ্ট্রপতির প্রয়াণে সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে ভারত সরকার। আজ মঙ্গলবার দিল্লির লোদি রোড শ্মশানে তার শেষকৃত্য হওয়ার কথা। সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীসহ অন্যদের থাকার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে কাল বুধবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। এদিন দেশের সব প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
প্রবণ মুখার্জির প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘ওর প্রয়াণ এক যুগের সমাপ্তি। রাষ্ট্রপতি ভবনকে সাধারণের জন্য খুলে দিয়েছিলেন তিনি।’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইটে জানিয়েছেন, ‘প্রণবদার চলে যাওয়া রাজনৈতিক জগতে অপূরণীয় ক্ষতি।’ কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী বলেছেন, ‘ভারতীয় রাজনীতির মহাকাশে বড় নক্ষত্রের পতন হল। আমরা কার কাছে আর পরামর্শ নিতে যাব? তিনি আমাদের কাছে ছিলেন পরামর্শদাতা।’
মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বিদেশি বন্ধু হিসেবে ২০১৩ সালের ৪ মার্চ প্রণব মুখার্জির হাতে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ তুলে দেয়া হয়। সেই বন্ধুর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এক শোকবার্তায় বলেছেন, প্রণব মুখার্জির মৃত্যু ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির জন্যই এক ‘অপূরণীয় ক্ষতি’।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘পরম সুহৃদ’ প্রণব মুখার্জির ‘অসামান্য অবদানের’ কথা স্মরণ করার পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনে একজন ‘অভিভাবক ও পারিবারিক বন্ধুকে’ হারানোর কষ্টের কথা বলেছেন তার শোকবার্তায়।
করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই সাবেক রাষ্ট্রপতির শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। ৯ আগস্ট তিনি নিজের বাড়িতে পড়ে যান। মাথায় আঘাত লাগে, অবশ হতে থাকে বাঁ হাতও। পরের দিনই তাকে দিল্লির সেনা হাসপাতালে নেয়া হয়।
চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে জানান, দ্রুতই অস্ত্রোপচার দরকার। অস্ত্রোপচারের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে গিয়ে বোঝা যায়, প্রণব মুখার্জির শরীরে বাসা বেঁধেছে করোনাভাইরাস। সেই খবর তিনি নিজেই টুইট করে জানিয়েছিলেন।
৮৪ বছর বয়সে এই ভাইরাসের থাবা থেকে নিরাপদে অস্ত্রোপচার করে সুস্থ করে তোলাটা চিকিৎসকদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েই তার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। তারপরই তাকে ভেন্টিলেশনে দেয়া হয়।
দু’দিন ধরে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। ফুসফুসে সংক্রমণের জেরে বাড়ে জটিলতা। শেষ পর্যন্ত সোমবার দীর্ঘ লড়াইয়ে হার মানলেন তিনি। তার প্রয়াণে শোকাহত ভারতের ডান-বাম সব রাজনৈতিক মহল।
প্রণবের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের অদূরের মিরিটি গ্রামে। বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং কংগ্রেস নেতা।
জেলা কংগ্রেস সভাপতি, এআইসিসি সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদেরও সদস্য হয়েছিলেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে রাজনীতি প্রণবের উত্তরাধিকারসূত্রেই পাওয়া।
যদিও সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজ বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন রাজনীতির ছায়া মাড়াননি তিনি। বরং ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পর্বের পর মন দিয়েছিলেন আইনের ডিগ্রি পাওয়ায়।
তবে আইনজীবীর পেশাকে বাছেননি কখনই। ডাক ও তার বিভাগে করণিক এবং হাওড়ার বাঁকড়া স্কুলে শিক্ষকতা পর্বের পর ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিদ্যানগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষকতায় যোগ দেন।
১৯৫৭ সালে নড়াইলের মেয়ে শুভ্রা দেবীকে বিয়ে করেন। বিদ্যানগর কলেজে যোগ দেয়ার পর টানা পাঁচ বছর আমতলাতেই ছিলেন প্রণব। মুখার্জি দম্পতির বেশ পছন্দও হয়ে গিয়েছিল জায়গাটি। সেখানে থিতু হওয়ার জন্য জমিও কিনে ফেলেছিলেন।
কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। ১৯৬৬ সালে বিদ্যানগর কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হরেন্দ্রনাথ মজুমদারের হাত ধরে, শুরু হওয়া রাজনৈতিক সফর প্রণবকে টেনে নিয়ে যায় অনেক দূরের অন্য ঠিকানায়।
কংগ্রেসি রাজনীতিতে বরাবর যা গুরুত্ব পেয়ে এসেছে, সেই পারিবারিক গরিমা কিন্তু প্রণব মুখার্জির তেমন ছিল না। যদিও তার বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। কিন্তু দেশের নানা প্রান্ত থেকে উঠে আসা অন্য অনেক কংগ্রেসি মহারথীর ক্ষেত্রে যে পারিবারিক আভিজাত্যই ছিল সবচেয়ে বড় সম্বল, প্রণব মুখার্জির ক্ষেত্রে তা ছিল না।
সাফল্যের পেছনে ছিল তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, মেধা এবং তার পরিশ্রম করার ক্ষমতা। যখন যে দায়িত্বই পেয়েছেন, সেটাকেই সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন।
তিনি রাষ্ট্রপতি পদে যাওয়ার আগে শেষ তিন বছর, অর্থাৎ ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত লোকসভার নেতা ছিলেন। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও প্রণব মুখার্জিকে সম্মান করতেন, নানা বিষয়ে তার উপদেশ নিতেন।
এত কিছুর পরও শিকড়কে ভোলেননি কখনও। দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে এত বছর বিচরণ করেও খাঁটি বাঙালিই থেকে গিয়েছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত। সেই ধুতি-পাঞ্জাবিই ছিল প্রিয় পোশাক। পুজোর সময়ে বীরভূমে নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরে পারিবারিক দুর্গোৎসবে তন্ত্রধারক হওয়াই ছিল তার জীবনের নিয়ম।
২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর নেয়ার পর সে অর্থে আর সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন না। কিন্তু তবু যেন থেকে গিয়েছিলেন রাজনীতির অভিভাবক হয়ে। তাই প্রণব মুখার্জির চলে যাওয়া ভারতীয় রাজনীতিতে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করল।
১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর যে দুঃসময়, সে সময়টাতেও ইন্দিরাজির প্রতি আনুগত্যে অবিচল থাকার পুরস্কারটাই ১৯৮০ সালে পেয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি। ১৯৮০ সালে ক্ষমতায় ফিরেই প্রণবকে ইন্দিরা ক্যাবিনেট মন্ত্রী করেছিলেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে প্রণব মুখার্জির ঘোর দুর্দিন শুরু হয় কংগ্রেসে।
রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম দিকে তিনি কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন। আলাদা দল গড়ে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন প্রণব মুখার্জি। পরে ১৯৮৯ সালে তিনি কংগ্রেসে ফিরে আসেন। পরে বাণিজ্যমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন।
মনমোহন সিংহের সেই মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন প্রণববাবু। প্রথমে তিনি ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। পরে হন অর্থমন্ত্রী। ২০১২ সালে দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে চলে গিয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার আগে পর্যন্তই তিনি থেকে গিয়েছিলেন ওই অবস্থানে। একজন বাঙালি হয়ে দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছানো অবশ্যই ইতিহাস তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু বলেছেন, ‘এক উজ্জ্বল রাজনৈতিক নক্ষত্রকে হারাল গোটা দেশ।’
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ টুইটারে লেখেন, ‘ভারতরত্ন প্রণব মুখার্জির প্রয়াণে শোকাহত। তিনি ছিলেন সুগভীর অভিজ্ঞতার অধিকারী। চূড়ান্ত দায়বদ্ধতার মাধ্যমে দেশের সেবা করেছেন। প্রণবদার উজ্জ্বল রাজনৈতিক জীবন সমগ্র দেশের কাছেই গর্বের।’
টুইটে রাহুল গান্ধী লেখেন, ‘প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির প্রয়াণের দুর্ভাগ্যজনক খবরে শোকাহত সমগ্র দেশ। সমগ্র দেশের সঙ্গে আমিও তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। পরিবার ও পরিজনদের প্রতি সুগভীর সমবেদনা জানাই।’
গভীরভাবে শোকাহত পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। শোকপ্রকাশ করে টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘প্রণববাবুর মৃত্যুতে জাতীয় জীবনে এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হল। ব্যক্তিগতভাবে প্রণববাবু আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বিভিন্ন সময়ে আমি তার মূল্যবান উপদেশ পেয়েছি। তিনি আমার জীবনে অভিভাবকতুল্য ছিলেন। রাজনীতি থেকে অর্থনীতি- সব বিষয়ে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি। চিরকৃতজ্ঞ থাকব। খুবই অভাব অনুভব করব। অভিজিৎ ও শর্মিষ্ঠাকে আমার সান্ত্বনা।’
নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি ওলির টুইট, ‘নেপাল একজন ভালো বন্ধুকে হারাল। ভারত ও নেপালের সম্পর্ক সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
সুত্রঃযুগান্তর।