শহরে যারা টোকাই হিসেবে কয়েক দশক আগেও পরিচিত ছিল, তারাই আজকের দিনের পথশিশু। মূলত এদের পরিবার পরিজন কিংবা মা-বাবা না থাকায় এরা ঠিকানা বিহীন। এদের নেই কোন ধরাবাঁধা জীবন।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত শহরগুলোতে এ পথশিশুরা নিজেরাই নিজেদের মত করে থাকতে ভালবাসে। তবে নিজেদের মত থাকতে গিয়ে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক এরা জড়িয়ে যাচ্ছে মাদকে। আবার স্বেচ্চায় যদিও কেউ পথশিশু হতে চায়না। পারিপার্শিক অবস্থা তথা পরিবারের অস্বচ্ছলতার কারণেই ছোট-ছোট শিশুরা পথশিশু হিসেবে আবির্ভুত হচ্ছে। এরা সবাই সমাজের সবচেয়ে নিচুস্তরের কাজে লিপ্ত। যেমন ঢাকা শহরে বিভিন্ন ট্রাফিক সিগনালে অনেক সময়ই দেখা যায় কেউ ফুল বিক্রি করছে, কেউবা গাড়ি পরিস্কারসহ বিভিন্ন কাজ করছে। কেউ ময়লার ভাগারে (ডাস্টবিন) পলিথিন সংগ্রহ করছে, পিঠে বস্তা নিয়ে কাগজ সংগ্রহ করছে, কেউবা প্লাস্টিকের বোতল। অর্থাৎ কিনা একেক শিশু একক কাজ করছে। কিন্তু এ কাজ করে অর্জিত অর্থ দিয়ে এ সব শিশু কি করে সে খবর হয়তোবা অনেকেই জানেনা। এভাবে অর্জিত অর্থ তারা খরচ করছে মাদকের পিছে। বিভিন্ন প্রকার মাদক গ্রহণ করে ঘুমানোই যেন তাদের কাছে স্বর্গ সুখ।
বিশ্বে এখন চলছে করোনা মহামারি। চলছে ঘোষিত ও অঘোষিত লকডাউন। এর মধ্যেই কয়েকদিন আগের গ্রিন রোডের পান্থপথ চৌরাস্তা এলাকার একটি গলিতে বিকেল বেলা দেখা গেল ১০-১২ বছর বয়সী এক পথশিশু তার চেয়ে বয়সে কিছুটা বড় এক বন্ধুর সঙ্গে বসে গাঁজা সেবন করছে। বন্ধুটি গভীর মনযোগে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েই তা দেখছিলাম আমরা কয়েকজন। কিন্তু কোন ভ্রুক্ষেপই করছেনা দুই গাঁজা সেবনকারী পথশিশু।
কিছুক্ষণ পর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, তোমরা কি করছ? তখন বাচ্চা ছেলেটির ঝটপট উত্তর- দেখছনা কি করছি? তাদের উত্তর শুনে বেশ বিস্মিত হলেও তাদের পাশেই বসে গেলাম কথা বলতে।
পথ শিশুটি জানাল, তার নাম নয়ন। আর তার বন্ধুর নাম মোহন। এক জনেরও বাবা-মা নেই। রাতে ফুটপাতে কিংবা কখনো-কখনো কমফোর্ট হাসপাতালের গেইটের কাছে গিয়ে ঘুমায়। দিনের বেলা তারা ডাস্টবিনের ময়লা হতে প্রয়োজনীয় জিনিস কুড়ায়। আর তা বিক্রি করে কাঁঠালবাগানের কয়েকটি দোকানে। মানিক জোড়ের মত সারাক্ষণ দু’জন এক সঙ্গেই কাটায়। দিন শেষে যা উপার্জন করে তা তাদের এক বড় ভাইয়ের কাছে জমা রাখে। ওই বড় ভাইয়ের কাছ থেকেই তারা মাদক যেমন- গাঁজা অথবা ড্যান্ডি (জুতার আঠা) ক্রয় করে।
মাদক গ্রহণের কারণ জানতে চাইলে নয়ন বলে আমার বাবা-মা নেই। আমার জন্মের দুই বছরের মাথায় বাবা মারা যায়। মা দ্বিতীয়বার বিয়ে করে এক রিকশাওয়ালাকে। সে আমাকে নিতে চায় না। মা চলে গেল। আমি শুধু কাঁদলাম। এমনি অবস্থায় খিদের যন্ত্রনায় একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করি। কয়েক দিন ভিক্ষে করেই কাটাই। কেননা আমার কিছুই করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু কিছু দিন পর দেখলাম এভাবে দিন চলছেনা। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম কাগজ কুড়াবো। শুধু কাগজ কুড়িয়েও পেটের ভাত যোগার করতে পারছিলাম না। এরপর কাগজের সঙ্গে ডাস্টবিন থেকে অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কুড়াতে শুরু করলাম। সারাদিন ময়লা ঘেটে প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে যা পাই, তা ওই বড় ভাইয়ের হাতে তুলে দিই। সে-ই আমাকে খাবার আর গাঁজা কিনে দেয়। এভাবেই চলছে আমাদের দিন। পড়াশুনা করতে ইচ্ছে হয় না? জানতে চাইলে বলে, সেটা কিভাবে সম্ভব? আরেক পথশিশু মোহন বলে, ওসব আমাদের দ্বারা হবেনা। আমরা কেবলমাত্র খেতে আর ঘুমাতে পারলেই সব।
সে বলে, এই এলাকায় শুধু আমরা নই। আমাদের মত অনেকেই গাঁজা, চাক্কি (ঘুমানোর ওষুধ) ড্যান্ডি (জুতার আঠা) সেবন করে। আবার কেউ-কেউ ইনজেকশন নেয়। এরপর দুজনেই বলতে থাকে এসব ছাড়াও আরও বেশ কিছু মাদক যেমন নকটিন (এক ধরনের পিল), গুল পাওয়া যায়। এখানকার প্রায় সব ছেলেরাই সেসব সেবন করে। কিন্তু আমরা শুধু গাঁজা আর ড্যান্ডি সেবন করি।
এরপর আরেক গলিতে গিয়ে দেখা গেল, আরো কয়েকজন পথশিশু খোলা রাস্তাতে দাঁড়িয়েই মাদক নিচ্ছে।
ড্যান্ডি বর্তমানে অধিকাংশ পথশিশুদের কাছে খুব জনপ্রিয় একটি মাদক। কারণ অল্প খরচে এবং খুব সহজে এটি পাওয়া যায়। এক বোতল ড্যান্ডি‘র মূল্য ১০০-১২০ টাকা।
পরিসংখ্যানে দেখা যায় দেশে বর্তমানে প্রায় দশ লাখ পথশিশু রয়েছে যার অর্ধেকের বয়স ১০‘এর নিচে। আর এসব পথশিশুদের মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ মাদক সেবন করে।
মাদক বিরোধী সংগঠন ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার সৈয়দা অনন্যা রহমান বলেন, বর্তমান সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। মাদকের ছোবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে না পারলে, আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার। এই শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম। পথশিশুরা খুব সহজেই মাদক জোগাড় করতে পারে। তাই আমাদের উচিত এ সংক্রান্ত আইনকে কাজে লাগানো। তবে মাদকের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করতে হবে সবার আগে।
তিনি বলেন, এ সব পথ শিশুদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। এসব পথশিশুদের পুনর্বাসনে সরকারসহ সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আহ্বান জানান তিনি।
মানবাধিকার কর্মী শায়লা আকতার বলেন, কেউ ইচ্ছে করে পথশিশু হয়না। কেউ যাতে পথশিশু না হয় দিকে আমাদের সবার আগে নজর দিতে হবে। এ জন্য সমাজের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এটা কেবল সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সমাজের সবার এগিয়ে আসতে হবে। কেবলমাত্র আইন করে পথ শিশুদের মাদক সেবন বন্ধ করা যাবে না। তাদের জন্য যথাযথ কাজ ঠিক করতে হবে। তারা যাতে সৎপথে আয়ের মাধ্যমে জীবন চালাতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, প্রচারণা। পথশিশুদের মাদক থেকে দূরে রাখতে সরকারি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসহ সমাজের সবারই এগিয়ে আসতে হবে।
-বাসস