প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বের যেখানেই করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে, বাংলাদেশ তা সংগ্রহের উদ্যোগ নেবে। এ বিষয়ে সরকার অর্থও বরাদ্দ রেখেছে।
বৃহস্পতিবার একাদশ জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া অধিবেশন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমের সমালোচনার আগে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সমালোচনা করব; কিন্তু যারা কাজ করে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখতে হবে।’ এ ক্ষেত্রে সমালোচনার সময় কিছু বিষয় বিবেচনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যাদের দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাদের মানুষ বিপদে পড়ে ডাকে, পুলিশকেই আগে ডাকে। এমন কিছু না করা যাতে তারা যেন আবার ভয়ে ভীত হয়ে তাদের কাজের যে উৎসাহটা সেটা যেন নষ্ট না হয়, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। সমালোচনা ভালো; কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে।’
সম্প্রতি কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে চারদিকে ব্যাপক সমালোচনা উঠেছে। এমনকি সংসদেও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবি জানান। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দেশে কারা শুরু করেছিল, সে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কারা শুরু করেছিল? এটা জিয়াউর রহমানের আমল থেকেই শুরু। আমাদের বহু নেতাকর্মীর লাশও পাওয়া যায়নি। কিছু দিন আগেও আমি পার্লামেন্টে বলেছি। এরকম বহু ঘটনা ঘটেছে। তারপর তো একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হল এবং সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি, এটাকে কীভাবে মোকাবেলা করা যায়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা যথাযথ কাজ করে যাচ্ছে এবং তারা যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে। তারা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে; কিন্তু সেগুলো করতে গিয়ে যদি কিছু দুর্ঘটনা ঘটে, সেটা ঘটা খুব স্বাভাবিক। আমরা কিন্তু কাউকে ছেড়ে দিচ্ছি না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কেউ এটা বলতে পারবেন না যে, অন্যায় করলে আমরা ছেড়ে দিচ্ছি। সেটা কিন্তু দেয়া হচ্ছে না।’
এর আগে প্রধানমন্ত্রী দেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ও এ বিষয়ে সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। করোনা মোকাবেলায় সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভ্যাকসিনের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশ গবেষণা করছে। সব দেশেই আমরা আবেদন দিয়ে রেখেছি। এর জন্য টাকাও বরাদ্দ করে রেখেছি। যেখান থেকে আগে পাওয়া যায়, আমরা সেটা নেব। দেশের মানুষকে করোনা থেকে মুক্ত করার জন্য যা যা ব্যবস্থা নেয়া দরকার-তা নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিন যেটা আবিষ্কার হল, আমরা তো আশাবাদী হয়েছিলাম অক্সফোর্ডেরটা নিয়ে। সেটা পরীক্ষা করতে গিয়ে যখন অসুস্থ হয়ে পড়ল, আমরা আবার একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে গেছি। তারপরও আমাদের প্রচেষ্টা আছে যে, পৃথিবীর যেখানেই আবিষ্কার হোক, বাংলাদেশ-আমার দেশের মানুষের জন্য আমরা সেটা সংগ্রহ করতে পারব।’
করোনা পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, করোনা চোখে দেখা যায় না। কিন্তু সারা বিশ্বকে একেবারে স্থবির করে দিয়েছে। বাংলাদেশে যখন এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় তখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সবাই এটা মোকাবেলায় একযোগে কাজ করেছে। প্রশাসন ও আমাদের রাজনৈতিক কর্মীরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়েছি বলেই আমরা মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। যতদূর সম্ভব আমরা সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। এর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা ছিল না, তারপরও যে যেভাবে পেরেছি সহায়তা করেছি।
করোনাকালে চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষাপটে সরকারপ্রধান বলেন, চিকিৎসাসেবা যাতে দিতে পারি তার জন্য হাসপাতাল প্রস্তুত, চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয়সহ সব ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। এ জন্য পানির মতো টাকা খরচ হয়েছে। আমরা টাকা-পয়সার দিকে তাকাইনি। এখানে হয়তো কেউ খুঁজে খুঁজে দুর্নীতি দেখতে পারে। যে মুহূর্তে এ ধরনের একটি দুর্যোগ মোকাবেলার চিন্তা করতে হয়েছিল তখন টাকা-পয়সা কী হবে? কত খরচ হল। কতটুকু ‘সিস্টেম লস’-তা বিবেচ্য ছিল না। আমাদের বিবেচ্য ছিল-মানুষকে বাঁচানো। কীভাবে মানুষকে রক্ষা করব। আর সেটা করেছি বলেই অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি; যেখানে এখনও বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ হিমশিম খাচ্ছে। আমাদের দেশের মতো ঘনবসতির দেশে এই কাজগুলো করা অত্যন্ত কঠিন। উন্নত বিশ্বে এই সমস্যাটা ছিল না।
তিনি বলেন, করোনার কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কী হবে, কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে-সেই বিষয়ে আমরা সজাগ ছিলাম। এ জন্য আমরা শুরু থেকেই সিদ্ধান্ত নিই, যথাযথ ব্যবস্থা নিই। দেশের মানুষ যাতে কষ্ট না পায়, সে জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি।
করোনাকালে নেয়া সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, ২১টি প্যাকেজে এক লাখ ১২ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছি, তা জিডিপির ৪ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এর বাইরেও নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আমার বিশেষ তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছি। প্রতিটি মসজিদ-মাদ্রাসায় টাকা পাঠিয়েছি। সরকারের প্রণোদনার বাইরেও আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, চলমান করোনার মধ্যে এলো ঘূর্ণিঝড় আম্পান। তারপর এলো দীর্ঘমেয়াদি বন্যা। একটার পর একটা আঘাত এসেছে। আমি চেষ্টা করেছি, দেশের মানুষের যেন কষ্ট না হয়। মানুষ যেন কোনো দুর্ভোগ না পোহায়। আল্লাহর রহমতে সেটা আমরা কাটাতে সক্ষম হয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল তখন করোনাভাইরাস মোকাবেলা, ত্রাণ বিতরণসহ অন্যান্য কাজে যেসব মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা ছিল, তারা কাজ করেছে। আমাদের কিছুদিন থমকে যেতে হয়েছিল। সবকিছু প্রায় বন্ধ অবস্থায় ছিল। সব কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যেও সরকার কিন্তু বসে থাকেনি। যার কারণে আমরা রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে পেরেছি। এখানে অবশ্য আরেকটা কারণ আছে-আমাদের খরচ কমেছে। করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের বিদেশ যাওয়া নেই, বিভিন্ন অনুষ্ঠান নেই। এসব কারণে আমাদের বেশ সাশ্রয় হয়েছে। সেটা আমরা মানুষের কল্যাণে ব্যয় করতে পারছি। মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৬৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। মাঝখানে কিছুদিন রফতানি একটু থমকে গেলেও আমাদের আমদানি-রফতানি এখন বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের মেগা প্রজেক্টগুলো থমকে গিয়েছিল; সেগুলোর কাজ এখন চলমান।
শিক্ষার্থীদের জন্য এক হাজার টাকা : শেখ হাসিনা বলেন, যেহেতু করোনাভাইরাসে সবার জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে, এ জন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি- শিক্ষার্থীদের আমরা এক হাজার করে টাকা দেব, যাতে তারা তাদের কাপড়-চোপড়, টিফিন বক্স ও প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারে।
নির্মাণে মানা হয়নি নীতিমালা : নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকায় বায়তুস সালাত জামে মসজিদ নির্মাণে কোনো নীতিমালা মানা হয়নি বলে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে এমন একটি জায়গায়, যেখানে গ্যাসের লাইন ছিল-সেই লাইনের ওপর। তার কোনো অনুমোদন ছিল না, কোনো নীতিমালা ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনা সত্যি খুব দুঃখজনক। জায়গাটাও কোনো মসজিদ কমিটির না। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণের ফলে যে দুর্ঘটনা ঘটে গেল, কতগুলো জীবন ঝরে গেল। ভবিষ্যতে কেউ যদি কোনো স্থাপনা করেন, অন্তত নিয়ম-নীতিমালা মেনে করবেন।’
ওয়াসার পানি একদম বিশুদ্ধ : রাজধানীর সাপ্লাই পানির দাম বৃদ্ধি নিয়ে বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের প্রশ্ন তোলায় তার জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পানির দাম যদি বেশি হয়, পানি কম ব্যবহার করেন। সীমিত আকারে ব্যবহার করেন। অপচয় করবেন না, আপনারই বিল কম আসবে।’ তিনি বলেন, ভালো জিনিস নিতে হলে তো একটু পয়সা দিয়ে নিতে হয়। ওয়াসার পানি কোনো খারাপ পানি না-একেবারে পিওর।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগে ঢাকা শহরে পানি সাপ্লাইয়ের কী অবস্থা ছিল? আজ পানি সবাই পাচ্ছে। আমরা পাইপলাইনগুলো পরিবর্তন করছি। দু-এক জায়গায় পানির সমস্যা দেখা দেয়। সেখানে তাদের ব্যক্তিগত পানির লাইনে সমস্যা থাকায় এমন হয়েছে। প্রত্যেকের উচিত অন্তত ৬ মাস পরপর লাইনগুলো চেক করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ঢাকা শহরে পানি সাপ্লাইয়ের যে অবস্থা ছিল, যখন আমরা সরকারে আসি-চারদিকে হাহাকার ছিল। কয়েক বছরের মধ্যে চাহিদার চেয়ে বেশি পানি আমরা সাপ্লাই দিতে পারছি। কোথায় পদ্মা নদী, সেখান থেকে পানি এনে পরিশোধন করে আমরা সাপ্লাই দিচ্ছি। এই যে বিশাল কর্মযজ্ঞ-এর একটু প্রশংসাও করবেন।’
সরকারদলীয় কেউ কথা বলার সুযোগই পায়নি : সংসদে বিরোধী দলের সরব উপস্থিতির জন্য তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই পার্লামেন্ট সেশনে যে বিল পাস হল এখানে কিন্তু আমাদের সরকারদলীয় কেউ কথা বলার সুযোগই পায়নি। একমাত্র বিরোধী দলেরই এই পার্লামেন্ট ছিল এবং তারাই কথা বলে গেছে। গত পাঁচ দিন তাদের উপস্থিতিটা প্রতি মুহূর্তে আমরা টের পেয়েছি। শুধু একদিন, যেহেতু আমাদের দু’জন সংসদ সদস্য মারা গেছেন, সে জন্য সেদিন আর পার্লামেন্ট চলেনি। কিন্তু তারপর বিল পাসের সময় একমাত্র বিরোধী দলের দখলে পার্লামেন্ট-এবার এটাই বলতে হবে।’
তিনি এ সময় প্রবাসী কর্মীদের পুনর্বাসনে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা কিন্তু বসে নেই। যাদের আনার কথা, আমরা স্পেশাল প্লেন পাঠিয়েও তাদের নিয়ে এসেছি এবং লাশ কিন্তু সব সময় আনা হয়। আর এখন তো প্লেনে যাতায়াতই বন্ধ। সব দেশেই বন্ধ। কোনো দেশে তো প্লেন ল্যান্ড করতেও দেবে না। কাজেই সেখান থেকে আমরা আনব কী করে? সেটাও তো দেখতে হবে।’
সুত্রঃ যুগান্তর।