পিইসি-জেএসসি ও এইচএসসির বোর্ড পরীক্ষার পাশাপাশি স্কুলপর্যায়ের অন্যান্য শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও আগামী এসএসসি পরীক্ষা কোন আঙ্গিকে হবে তার কোনো ছকই এখনো তৈরি হয়নি।
এমনকি বোর্ডপর্যায়ের এ পরীক্ষার জন্য পাঠ্যসূচি কতটা সংক্ষিপ্ত করা হবে তারও কোনো আগাম পরিকল্পনা নেই। যদিও এরই মধ্যে তাদের প্রি-টেস্ট পরীক্ষার সময় পেরিয়ে গেছে। টেস্ট (নির্বাচনী) পরীক্ষার সময়ও খুব কাছাকাছি। অথচ নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তারা মাত্র তিন-চার সপ্তাহ পূর্ণাঙ্গ ক্লাস করতে পেরেছে। এর পরপরই করোনার কারণে সারা দেশে সব স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আগামী বছর ফেব্রম্নয়ারিতে কিংবা এর থেকে আরও এক-দুই মাস পিছিয়ে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হলে এর ফলাফল কেমন হবে তা নিয়ে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ সময় অক্টোবর মাসে এসএসসির টেস্ট পরীক্ষা হয়ে থাকে। আর এ পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নের ধরনসহ আনুষাঙ্গিক বিষয়ে পর্যাপ্ত ধারণা পেয়ে থাকে। অথচ করোনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসলেও ওই সময়ে টেস্ট পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ কম। এছাড়া এ অবস্থায় বোর্ডপরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের ভালো রেজাল্ট করার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ।
এদিকে পরীক্ষার্থীরা মনে করে, নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকেই তারা যেহেতু নিয়মিত ক্লাস করতে পারেনি এবং প্রি-টেস্ট ও টেস্ট পরীক্ষাও তারা ঠিকমতো দেওয়ার সুযোগ তারা পাচ্ছে না- এক্ষেত্রে সিলেবাস বেশখানিকটা সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত। আর তা আগেভাগেই শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেওয়া জরুরি। কেননা, তা না হলে সারা বছর পূর্ণাঙ্গ সিলেবাস দেখে লেখাপড়া করার পর শেষ সময়ে এসে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস দেওয়া হলে তা তাদের কোনোই উপকারে আসবে না।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বেশ কয়েকজন এসএসসি পরীক্ষার্থী জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের পুরোটাই অন্যান্য সময়ের মতো ভর্তি পরীক্ষা, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মিলাদ-মাহফিলের মধ্যদিয়ে পার হয়েছে। এ সময় সামান্য কিছুদিন ২-৩টি বিষয়ে ক্লাস নেওয়া হয়েছে, যা ফেব্রম্নয়ারি মাসে বেড়ে ৫-৬ পিরিয়ডে এসে দাঁড়িয়েছে। মার্চের শুরু থেকে পূর্ণাঙ্গ ক্লাস শুরু হলেও করোনার কারণে তৃতীয় সপ্তাহে এসে স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে নতুন বছরের সিলেবাস অনুযায়ী অঙ্ক-ইংরেজি-বিজ্ঞানসহ কোনো সাবজেক্টেরই এক-দুটির বেশি অধ্যায়ের পাঠ্যদান শেষ হয়নি। অথচ এরই মধ্যে স্কুল শিক্ষকরা সেপ্টেম্বরে অনলাইনে প্রি-টেস্ট পরীক্ষা নেওয়া হবে বলে শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দিয়েছেন, যা তাদের কাছে গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াবে।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, জুলাই মাস থেকে স্কুল শিক্ষকরা অনলাইনে পাঠদান শুরু করলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এতে নিয়মিত যোগ দিতে পারেনি। বিদু্যৎ বিভ্রাট, দুর্বল ইন্টারনেট কানেকশন এবং আকস্মিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় প্রায়ই শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে বিঘ্ন ঘটছে। এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে অভিভাবক চাকরি হারানোর কারণে শিক্ষার্থীদের অনেককে পরিবারের সঙ্গে গ্রামে চলে যেতে হয়েছে। যারা সেখানে অনলাইনে ক্লাস করতে পারেনি। কেননা দেশের অনেক গ্রামে এখনো নেটওয়ার্ক সংযোগ নেই।
এছাড়া অনলাইন ক্লাসের জন্য যে টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রয়োজন, তা-ও অনেক শিক্ষার্থীর নেই। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত অনেক শিক্ষার্থীর কাছে অনলাইনে ক্লাস বিলাসিতার শামিল। কেননা অনলাইনে ক্লাস করতে হলে উচ্চগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট, ভালো স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ প্রয়োজন। অথচ মধ্যবিত্ত কোনো কোনো পরিবারে একটি স্মাট ফোন বা ল্যাপটপ থাকলেও একাধিক ভাইবোন শিক্ষার্থী হওয়ায় তারা এককভাবে তা ব্যবহার করতে পারছে না।
এছাড়া এ মহামারিতে এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের কাছে এ মুহূর্তে সন্তানের অনলাইনে ক্লাস করার জন্য স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার কেনা অসম্ভব। ফলে এ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তক ও গাইড বই দেখে নিজেরা নিজের চেষ্টায় কোনোরকমে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় অনলাইনে প্রিটেস্ট পরীক্ষা নেওয়া হলে তাদের কী হবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ওইসব শিক্ষার্থী।
এদিকে অনলাইনে প্রি-টেস্ট পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে রাজধানীর অন্যান্য স্কুলের শিক্ষার্থীরাও চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে। তাদের ভাষ্য, বিদু্যৎ বিভ্রাট, লোডশেডিং ও আকস্মিক ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনা নগরীতে অহরহই ঘটছে। এ অবস্থায় পরীক্ষা চলাকালীন কোথাও এসব সংকট দেখা দিলে ওই এলাকার শিক্ষার্থীদের বিপাকে পড়তে হবে। অথচ এসব সংকটে পড়ে যেসব শিক্ষার্থী ওই সময় পরীক্ষা দিতে পারবে না তাদের পরবর্তীতে কি সুযোগ দেওয়া হবে তা স্কুল শিক্ষকরা স্পষ্ট করছেন না, যা নিয়ে তাদের মধ্যে আরেক ধরনের ভীতি সৃষ্টি হয়েছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এইচএসসি পরীক্ষা হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকলেও এ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যেহেতু নিয়মিত ক্লাসের পাশাপাশি কোচিংও করতে পেরেছে, সেক্ষেত্রে তাদের পরীক্ষা ২-৪ মাস আগে-পরে হলেও ততটা সমস্যা হবে না। অথচ এসএসসি পরীক্ষার্থীরা এ ধরনের কোনো সুযোগ পায়নি। তাই বিকল্প কোনো পথে তাদের মেধা যাচাই করা কঠিন হবে। অথচ এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলই একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের প্রথম টার্নিংপয়েন্ট। এর ওপরই উচ্চশিক্ষার ভিত্তি নির্ভর করে। এ পরীক্ষার ফলাফলের ওপরই শিক্ষার্থীরা ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ঢাকাসহ বিভিন্ন মহানগরী ও জেলা শহরে বসবাসকারী উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা একাধিক বিষয়ে শিক্ষকদের কাছে অনলাইনে কোচিং করতে পেরেছে। অথচ স্বল্প আয়ের পরিবারের সন্তানরা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে আর্থিক সঙ্গতি থাকলেও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থী অনলাইনে কোচিং করার কোনো সুযোগ পায়নি। এছাড়া বন্যাদুর্গত এলাকার এসএসসি পরীক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ঘরে বসেও পড়াশোনা করতে পারেনি। এ অবস্থায়শিক্ষার্থীদের ফলাফলে ব্যাপক তারতম্য হবে, যা আগামী দিনের শিক্ষায় ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি করবে।
রাজধানীর ফয়জুর রহমান আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থী আবু সায়েম জানান, তার যেসব সহপাঠী ঢাকায় রয়েছে, তারা প্রায় সবাই এপ্রিলের শুরু থেকে একাধিক বিষয়ে অনলাইনে শিক্ষকদের কাছে কোচিং করছে। বিশেষ করে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইলেক্ট্রিভ ম্যাথ ও কেমিস্ট্রিসহ সাইন্সের সব সাবজেক্টই শিক্ষকদের কাছে পড়ছে। অথচ তাদের যেসব সহপাঠী করোনা শুরুর পর পরিবারের সঙ্গে গ্রামে অবস্থান করছে তারা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সায়েম জানান, তার বেশ কজন ঘনিষ্ঠ সহপাঠী প্রায়ই ফোন করে সাইন্সের বিভিন্ন সাবজেক্টের জটিল অধ্যায়গুলো বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সে-ও তাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ তাদের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগের সুযোগ না থাকায় তাদেরকে সবকিছু সঠিকভাবে বোঝাতে পারছে না। এ অবস্থায় তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে তারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে।
উলেস্নখ্য, এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা প্রতিবছর ফেব্রম্নয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়। এ পরীক্ষার টেস্ট (নির্বাচনী) পরীক্ষার আয়োজন করা হয় অক্টোবর মাসে। নভেম্বরে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করতে হয়। এরপর পরীক্ষার্থীদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা হয়। তবে নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের হিসাব থেকেও এর প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যায়। এ হিসেবে এবারের এসএসসির পরীক্ষার সংখ্যা সাড়ে ২০ লাখের কিছু বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে করোনার নেতিবাচক নানা প্রভাব ও সংকটে বেশ কিছু শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা বাতিলের ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের উপস্থিতিতে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিবের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর ভিত্তিতে উভয় মন্ত্রণালয়ে পৃথক দুটি সারসংক্ষেপ তৈরি করে এটি অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়েছে। সেখান থেকে অনুমোদনের পর এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অন্যদিকে এইচএসসি পরীক্ষার দিনক্ষণ নির্ধারণ করা না হলেও করোনা পরিস্থিতি বুঝে তা নেওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে। তক্ষার অন্তত এক মাসে পরীক্ষাসূচি শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেওয়া হবে।বে পরী স্বাভাবিক সময়ের দুই-চার মাস পরেও গতানুগতিক নিয়মে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হলে শহর ও গ্রামের